ছাত্রলীগের কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে নেয়া হবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। সংগঠনে থাকবে না প্রটোকলের রাজনীতি, বন্ধ হবে বিলাসী জীবনযাপনের প্রচলিত ধারা। স্বচ্ছতা নিশ্চিতে প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সম্পদের হিসাব দিতেও প্রস্তুত। শিগগিরই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের পদায়ন করা হবে। সারা দেশের সাংগঠনিক রিপোর্ট নিয়ে তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে গঠন করা হবে নতুন কমিটি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণরুম ও গেস্টরুমে শিক্ষার্থী হয়রানি বন্ধে থাকবে বিশেষ নির্দেশনা। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সার্বিক দিকনির্দেশনা নিয়েই সব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এমন প্রতিশ্রুতিই ব্যক্ত করলেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মধুর ক্যান্টিনের গোলঘরে যুগান্তরের প্রতিনিধির সঙ্গে ছাত্রলীগের নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই নেতার আলাপচারিতায় এই প্রতিশ্রুতি ছাড়াও নানা বিষয় উঠে এসেছে। ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা তাদের কর্মপরিকল্পনাও তুলে ধরেন। কমিটির বাকি ১০ মাস মেয়াদে দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দু’জনই কথা বলেন অভিন্ন সুরে।
জয় বলেন, একটি বিশেষ সময়ে আমাদের কাঁধে ছাত্রলীগের দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করে অর্পিত দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রটোকলের রাজনীতি করব না। জনগণকে কষ্ট দেব না। তাই দায়িত্ব পাওয়ার পরও ঢাবি হলেই থাকছি। সাংগঠনিক কাজ ত্বরান্বিত করতে সংগঠনের কার্যালয়ে নিয়মিত বসছি। ছাত্রদের কাছাকাছি থাকা, তাদের ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছি।
এ সময় লেখক ভট্টাচার্য সভাপতির সঙ্গে যোগ করে বলেন, ছাত্রলীগের আমরা সবাই কর্মী। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিষয়টি আলাদাভাবে দেখছি না। এটি অতিরিক্ত দায়িত্ব। আমরা চাই না অন্য নেতাকর্মীদের চেয়ে আমাদের ‘লাইফস্টাইল’ আলাদা হবে। মানুষের মধ্যে ছাত্রলীগ নিয়ে আর কোনো বিরূপ ধারণা তৈরি হোক তা চাই না। আমাদের প্রধান কাজ ছাত্রদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকা, প্রটোকল নিয়ে ঘোরা নয়।
দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলেন, দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। এই বার্তা এবং উন্নয়নের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়াও আমাদের দায়িত্ব। কেউ যদি উল্টো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ায়, কোনোভাবেই তাকে ছাড় দেব না। অপরাধীদের বিষয়ে আমাদের ‘জিরো টলারেন্স’ থাকবে। সংগঠনের নামে অপকর্ম করলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে।
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেন, ব্যক্তির দায় কখনই সংগঠন নেবে না। অপকর্মের বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত বার্তা সংগঠনের সব পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। অপরাধী, পৃষ্ঠপোষক কাউকেই ছাড় দেব না। নেত্রীর নির্দেশনায় যে শুদ্ধি অভিযান চলছে তা সেখানে আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে।
ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনের বিস্তর অভিযোগ নিয়ে দুই নেতা বলেন, বিলাসী নয়, সাদামাটা জীবনযাপন করতে চাই। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ বা মিডিয়া যদি আমাদের সম্পদের হিসাব চায়, আমরা দিতে প্রস্তুত। সর্বোচ্চ স্বচ্ছতায় এগিয়ে যেতে চাই। সংগঠন পরিচালনার খরচ আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই নেব। পাশাপাশি সংগঠনের জন্য ফান্ড তৈরির পরিকল্পনা আছে।
ছাত্রলীগের ১১১টি সাংগঠনিক ইউনিটের ১০৯টিই মেয়াদোত্তীর্ণ বা কমিটি নেই। এ প্রসঙ্গে জয় বলেন, আমরা রিপোর্ট সংগ্রহ করছি। খুব শিগগিরই চূড়ান্ত রিপোর্ট নিয়ে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে আসব। লেখক বলেন, আমরা গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে কমিটিগুলো করব। যেসব ইউনিটে সম্মেলনের পরও কমিটি হয়নি বা ভেঙে দেয়া হয়েছে সেগুলোতে আগে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে, পরে মেয়াদোত্তীর্ণ ইউনিটগুলোর সম্মেলনের দিকে যাব।
পাশাপাশি জেলা কমিটির মাধ্যমে উপজেলা, কলেজ, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির তদারকি করা হবে। বিতর্কিতদের প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলেন, বিতর্কিতদের অবস্থান ছাত্রলীগে হবে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাদের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। খুব শিগগিরই তাদের বাদ দিয়ে নতুনদের পদায়ন করা হবে। এর আগে সংবাদ সম্মেলনে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বলেন, সেখানকার অনেকেই নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে সক্ষম হয়েছেন।
আমরা চাই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা। কারণ দু’দিন পরপর তো আর কাউকে বাদ দেয়া বা ঢোকানো যাবে না। সে কারণে সব পর্যায় থেকে নিশ্চিত হয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। যোগ্যদের শূন্যপদ দেয়া হবে। তবে পদবঞ্চিত আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই যে দেয়া হবে তা নয়, দেয়া হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে।
নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে জয় বলেন, ছাত্রলীগে মাদকসেবীদের জায়গা হবে না। শাখাগুলোতে সবচেয়ে যোগ্যরাই আসবে। লেখক বলেন, কমিটির কোনো পর্যায়ে কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেব না। ছাত্রলীগ তার নিজস্ব ধারায় চলবে। পোর খাওয়া নেতারাই নেতৃত্বে আসবে। সবাইকে নিয়ে কাজ করার চিন্তার কথা জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলেন, সংগঠনে চেইন অব কমান্ড মানতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই নেয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমরা সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। কোনো বিভাজন থাকবে না। ডাকসু কার্যকর করার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে জয় বলেন, ডাকসুর শিক্ষার্থীবান্ধব সব কাজে পাশে থাকব। আমাদের নিজস্ব কর্মসূচিও চলবে। ডাকসু’র আগামী নির্বাচনে ২৫টি পদের ২৫টিতে আমরা জয়ের আশা করছি।
ছাত্রদলকে উদ্দেশ করে লেখক বলেন, ছাত্রলীগ বরাবরই সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তাদের সবার আগে ছাত্র হতে হবে। অছাত্ররা ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের কথা বললে তা হবে খুবই বেমানান। গণরুম-গেস্টরুম প্রসঙ্গে লেখক বলেন, আমরা কাউকে গণরুমে থাকতে বাধ্য করি না। হলের আসনের চেয়ে শিক্ষার্থী বেশি। তাই বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের কক্ষে সাধারণ ছাত্রদের থাকতে দেয়। এখানে দোষের কি আছে? তিনি বলেন, এরপরও গণরুমে যাতে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা না হয় সেই নির্দেশনা থাকবে। গণরুমকে আমরা ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে আসতে চাই। সেখানে আবৃত্তি, আলোচনা, পাঠচক্রের মতো আয়োজন থাকবে।
অপসারিত ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ব্যক্তিগত ত্রুটি একটি বিষয় এবং সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা আরেকটি বিষয়। আমরা তাদের ব্যক্তিগত ত্রুটিগুলো এড়িয়ে চলব এবং সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাগুলো নিব।