কলেজ পড়ুয়া এক তরুণীর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হকের। পরিচয়ের পর থেকে তিনি তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতেন। সময় সুযোগ পেলে দেখাও করতেন। এভাবে তিনি ওই তরুণীর কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। লেখাপড়া শেষ করে ওই তরুণীর প্রয়োজন হয় একটি চাকরির। পরে চাকরি পাইয়ে দেবার কথা বলে ঢাকার একটি হোটেলে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন ওসি মাহমুদুল। এভাবে মাসের পর মাস তিনি তাকে ধর্ষণ করেন। এক সময় ওই তরুণী অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়েন।
পরে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বাচ্চাও নষ্ট করান। এরপর তিনি ওই তরুণীকে বিয়ে না করে তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। যোগাযোগ করলে ওসি তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শণ করেন। উপায়ন্তর না পেয়ে তরুণী প্রথমে ডিএমপি কমিশনার ও পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর অভিযোগ করেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তদন্ত রিপোর্ট ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে জমা দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। ডিএমপি থেকে এই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে পুলিশ সদরদপ্তরে।
ভুক্তভোগী ওই তরুণী বলেন, পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হকের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। একটি সরকারি কলেজে পড়ালেখার সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয়। ফোনে কথা এবং দেখাও হত। এরই মধ্যে আমি লেখাপড়া শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখন তিনি আমাকে চাকরি পাইয়ে দেবার কথা বলে ২০১৭ সালের ২১ শে সেপ্টেম্বর ঢাকা নিয়ে আসেন। থাকার জন্য আমাকে পল্টনের ক্যাপিটাল হোটেলে নিয়ে যান। সেখানে আমার জন্য হোটেল বয়কে দিয়ে স্যুপ আনান। আমি সেই স্যুপ খেতে চাইনি। কিন্তু তিনি আমাকে জোর করে সেই স্যুপ খাওয়ান। এরপর আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি মনে নাই। রাত ২টার দিকে যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে তখন দেখি আমার পাশে ওসি মাহমুদুল শুয়ে আছেন। আমার বুঝতে আর বাকি ছিল না যে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি। কেন এমনটা করেছেন তার জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন ‘ আমাকে তিনি ভালবাসেন’ আমাকে তিনি বিয়ে করতে চান। সরাসরি প্রস্তাব দিলে হয়তো আমি রাজি হব না কারণ তার বউ আছে। আর তার বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না। তিনি আমাকেই বিয়ে করবেন বলে এমনটা করেছেন। নিরুপায় হয়ে আমি তখন সবকিছু মেনে নেই। এরপর থেকে প্রতি সপ্তাহে আমাকে ঢাকা এনে ওই হোটেলে রেখে শারীরিক সম্পর্ক করতেন।
গত বছরের ২০শে অক্টোবর আমি অন্তঃস্বত্তা হয়ে যাই। আমি বাচ্চা নিতে চাইলে তিনি আমাকে নিষেধ করেন। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হয়। এরপর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাচ্চা নষ্ট করতে আমাকে বাধ্য করে। আমি তাকে বিয়ের চাপ দিতে থাকি। কিন্তু ২রা এপ্রিল থেকে হঠাৎ করেই আমার সঙ্গে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি তার কর্মস্থল পল্টন থানায় যাই। সেখানের অনেকেই বিষয়টি জেনে যায়। পরে তিনি আমাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন এবং যোগাযোগ রেখে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করার আশ্বাস দেন। ঢাকা থেকে ফিরে তার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি আমি আমার বাবাকে জানাই। বাবা বিষয়টি মেনে নেন। অথচ কয়েকদিন পরে মাহমুদুলের বাবা আমাকে ও আমার পরিবারকে হুমকি দিয়ে বলেন, আমি যদি তার ছেলের জীবন থেকে না সরে যাই তবে আমার ব্যবস্থা নিবে এবং আমার চাকরি বাতিলের ব্যবস্থা করবেন।
ওই তরুণী বলেন, আমি যখন দেখি তার বাবা আমার বিপক্ষে চলে গেছেন তখন আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নেই। ১২ই এপ্রিল আমি ২০টি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার পরিবারের লোকজন আমাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করায়। ওই রাতে আমার ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ার বিষয়টি তার বাবাকে জানালে তিনি উল্টো হুমকি দেন আর বলেন, আমরা যেন তার ছেলেকে বিরক্ত না করি। বিরক্ত করলে ক্ষতি আমাদেরই হবে। সুস্থ হয়ে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলি আমাকে বিয়ে না করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবো। কিন্তু তিনি উল্টো আমাকে হুমকি দিয়ে টাকার গরম দেখিয়ে বলেন তিনি পল্টন থানার ওসি। তার অনেক চেনা জানা আছে। অনেক কিছু ধামাচাপা দিতে পারেন। ভুক্তভোগী তরুণী বলেন, পরে আমি বাধ্য হয়ে মতিঝিল জোনের এডিসি শিবলী নোমনকে বিষয়টি জানাই। তিনি বিষয়টি মিমাংসা করে দিবেন বলে জানান। মাহমুদুলের বাবাকে আবার সমাধানের জন্য বলি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পরে আমি আইজিপি বরাবর অভিযোগ করি। তরুণী বলেন, আমি ঢাকার বাইরে চাকরি করি। সেখানে তিনি ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন। হোটেলে থাকাকালীন দুজনের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্কের অনেক ভিডিও ও ছবি ধারণ করা হয়েছে। যেগুলো তার কাছে আছে বলে ওই তরুণী জানান।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পহেলা আগস্ট ওই তরুণী আইজিপি বরাবর অভিযোগ দিলে বিষয়টি তদন্তের জন্য দায়িত্ব পান ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের সবুজবাগ জোনের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মোনালিসা বেগম। তিনি তদন্ত করে ওসির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পান। প্রতি মাসেই ক্যাপিটেল হোটেলে ওসির নামে হোটেল বুকিংয়ের তথ্য মিলেছে। হোটেলের তথ্য মতে সর্বশেষ চলতি বছরের ১৭ই মার্চ ওই হোটেল থেকে চেক আউট করেন ওসি। এছাড়া কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ওই তরুণীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছেন ওসি। তদন্ত কর্মকর্তা মোনালিসা বেগম একটি তদন্ত প্রতিবেদন ডিএমপি হেডকোয়াটার্সে গত বুধবার জমা দিয়েছেন। ডিএমপি থেকে সেটি আবার পুলিশ সদরদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখন পুলিশ সদরদপ্তর তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিবে।
অভিযোগের বিষয়ে পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। আর তদন্ত কর্মকর্তা এডিসি মোনালিসা বেগম জানিয়েছেন, তিনি অভিযোগের তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। ওসির বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ওসি মাহমুদুল হক ২০০১ সালে এসআই পদে পুলিশে যোগ দেন। তার বাড়ি নওগাঁ জেলায়। চাকরি জীবনে তিনি একটি গুরুদণ্ড এবং ২২টি লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। ২০১৭ সালের ২রা জুলাই তিনি পল্টন থানার ওসি হিসাবে যোগ দেন। স্ত্রী ও এক সন্তানের জনক তিনি।