ক্লাব ব্যবসার আড়ালে রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেফতার যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ওরফে ক্যাসিনো খালেদকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এসময় তিনি কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের নাম বলেছেন। খালিদের দাবি এরা তার অবৈধ ক্যাসিনোর আয় থেকে নিয়মিত মাশোয়ারা নিত। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে প্রতিমাসেই তাদের বখরা দিতে হতো তাকে।
একইসঙ্গে কোন ক্যাসিনো থেকে কত টাকা আয় করতেন এবং চাঁদাবাজির অর্থের পরিমাণও জানিয়েছেন খালেদ। খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, পুলিশের পর দ্বিতীয় দফায় দশ দিনের রিমান্ডে নিয়ে খালেদকে বর্তমানে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব।
জিজ্ঞাসাবাদে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা পূর্বাচল প্রকল্পে প্লটের জন্য ৫ কোটি টাকা নিয়েছেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউছার এবং ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটও তার কাছ থেকে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রভাবশালী নেতাকেও দুই দফায় মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নিতেন। খালেদ তার সাম্রাজ্য ধরে রাখতে গড়ে তুলেছেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী।
এর মধ্যে ১২ অস্ত্রধারী ক্যাডার সার্বক্ষণিকভাবে তার সঙ্গে থাকত। কিন্তু এখন এদের কারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খালেদ জানিয়েছেন, অবৈধ আয়ের টাকা নিজের এবং স্ত্রীর নামে ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিনি গচ্ছিত রেখেছেন।
সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে তার তিনটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। দেশি-বিদেশি ব্যাংকের এসব হিসাবে প্রায় ৩১ কোটি টাকা গচ্ছিত রেখেছেন তিনি।
খালেদের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা র্যাব-৩ উপপরিচালক ফায়জুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যুবলীগ নেতা খালেদের রিমান্ড চলছে। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। রিমান্ড শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।’
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খালেদ তার অবৈধ আয়ের কয়েকটি উৎসের কথা বলেছেন জিজ্ঞাসাবাদে। তিনি বলেছেন, মতিঝিলের ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে তিন মাসে ৪০ লাখ টাকা আয় করতেন।
মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাবের ক্যাসিনো থেকে তার মাসিক আয় তিন লাখ টাকা। ফুটপাত থেকে তিনি মাসিক ২০ হাজার টাকা নিতেন। শাহজাহানপুর লেগুনাস্ট্যান্ড থেকে নিতেন ৩০ হাজার টাকা। শাহজাহানপুর রেলওয়ে গেট বাজার থেকে নিতেন ৬০ হাজার টাকা।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, খালেদ বিভিন্ন উৎস থেকে অবৈধ আয়ের যে হিসাব দিয়েছেন, প্রকৃত আয় আরও বেশি।
জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, খালেদ অবৈধ আয়ের ভাগীদার হিসেবে যাদের নাম বলেছেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন।
এদের একজন খালেদের কাছ থেকে পূর্বাচল প্লটের জন্য ৫ কোটি টাকা নিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর ইসমাইল হোসেন সম্রাট একাধিক ঠিকানা বদল করে এই প্রভাবশালী নেতার বাসায় আত্মগোপন করেন।
এদিকে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ জানিয়েছেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউছার তার কাছ থেকে ২০১৫ সালে ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকা নিয়েছেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা।
আবদুর রহমান এবং নুরুল হুদা নামে দু’জন নিয়েছেন ২ কোটি টাকা। আনিছুর রহমান নিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা দুই ঈদে তার কাছ থেকে নিয়েছেন ২০ লাখ টাকা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, খালেদ তাদের বলেছেন, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। তবে ঢাকার ক্লাবপাড়াসহ নগরীর ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট।
এছাড়া ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক ছিলেন মোল্লা আবু কাউছার। দিলকুশা, মোহামেডান এবং আরমাবাগ ক্লাবের ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক ছিলেন সিঙ্গাপুরে পলাতক যুবলীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউছার যুগান্তরকে বলেন, খালেদ যদি টাকা দেয়ার দাবি করে থাকে সেটা ঠিক নয়। আর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি আমি। তবে আমি ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নই।
খালেদ রাজধানীর মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশিরভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কমলাপুর এলাকায় ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার।
উল্লেখ্য, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ প্রকাশের চার দিনের মাথায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। ওই দিনই গুলশান-২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কে খালেদের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে গুলশান ও মতিঝিল থানায় চারটি মামলা করে র্যাব।
১৯ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় করা অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পরে মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। র্যাব ২৭ সেপ্টেম্বর খালেদকে দুই মামলায় পাঁচ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়।