বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের যে রুমটিতে (২০১১) বর্বর নির্যাতন চালিয়ে আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়, সেই রুমটি এখন তালাবদ্ধ। এই হলের ২০০৫ ও ৩০১২ নম্বর রুমও ছিল টর্চার সেল।
এসব রুমে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল বলে অভিযোগ করেন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দারোয়ান ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। বহিরাগত নেতাদের নিয়ে এসব রুমে নিয়মিত বসত মদের আড্ডা।
হলের একজন দারোয়ান বলেন, বহিরাগতদের নিয়ে তারা (নেতারা) ব্যাগভর্তি মদের বোতল নিয়ে হলে ঢুকতেন। আড়চোখে তাকালেই বকা খেতে হতো। ওই তিনটি রুমের দরজার পাশে সবসময় ১৫-২০ জোড়া জুতা থাকত। রুমের ভেতর রাতদিন চলত মাতলামি। এসব রুমের দেয়ালও হয়তো এসব দেখে কাঁদত। কিন্তু কারও কিছুই করার ছিল না। সবাই মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন।
শনিবার দুপুরে শেরেবাংলা হলের মূল ফটকে যেতেই দু’জন দারোয়ান আটকে দিলেন এই প্রতিবেদককে।
নিজের পরিচয় দেয়ার পর বোর্ডে টাঙানো ‘বহিরাগত ও মিডিয়াকর্মী’ প্রবেশ নিষেধ দেখিয়ে বললেন, ভেতরে যাওয়া নিষেধ আছে। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর একজন শিক্ষকের সহায়তায় রুম তিনটি ঘুরে দেখার সুযোগ হয়।
সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতেই চোখে পড়ল সিঁড়ি ঘেঁষে ১২-১৩টি সাইকেল। ২০১১ নম্বর রুমটির বাইরে দরজার পাশে দেখা গেল একটি আলমারি। দরজায় দাঁত বের করা একটি ভূতের মতো ছবি আঁকা, এর নিচে লেখা ‘বারেক’। নিচে ৫ জোড়া জুতা পড়ে আছে।
রুমটির দরজায় তালা ঝুলানো থাকলেও জানালার ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখা যায়, বুক সেলফসহ দুটি খাট। এলোমেলোভাবে পড়ে আছে জামাকাপড়, ব্যাগ, বই-খাতা, চার্জার…। খাটের নিচে টিনের দুটি বাক্স। আছে প্লাস্টিকের তিন ড্রয়ারবিশিষ্ট একটি ওয়্যারড্রপ। রুমটির মেঝেতে প্লাস্টিকের মাল্টিকালারের ম্যাট বিছানো। রয়েছে একাধিক পানির বোতল। জানালা ও বারান্দার দরজার গ্লাসগুলো কাগজ দিয়ে ঢাকা।
দেয়ালে টাঙানো আরবিতে ‘আল্লাহ’ লেখা একটি ওয়ালম্যাট। এ রুমের ভেতরেই নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরারকে। গ্রেফতার আসামিদের প্রায় সবাই রুমটির ভেতর উল্লাস করতে করতে তাকে পেটায়।
ঘাতকরা যে দীর্ঘ সময় ধরে আবরারকে এখানে পিটিয়ে হত্যা করেছে, এর ছাপ রয়েছে রুমটিতে। রুমের সবকিছুই এলোমোলো, ছড়ানো-ছিটানো। রুমটি ছিল টর্চার সেলের মধ্যে অন্যতম। এখান থেকেই সোমবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় চারটি মদের বোতল, চারটি ক্রিকেট স্টাম্প, একটি চাপাতি ও দুটি লাঠি উদ্ধার করেন।
দ্বিতীয় তলায় রয়েছে আরেকটি টর্চার সেল- ২০০৫ নম্বর রুম। কোনো শিক্ষার্থী নেতাদের মর্জির বাইরে কাজ করলে এ রুমে এনে নির্যাতন চালানো হতো। শনিবার রুমটির দরজায় দুটি তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। জানালা ও দরজার গ্লাসগুলোও কাগজে ঢাকা। বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে স্যান্ডেল। জানালার গ্লাসের ভাঙা ছিদ্র দিয়ে দেখা যায়, জানালার পাশে একটি টিফিন ক্যারিয়ার। অবশিষ্ট খাবার পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ৪টি আলমারির মধ্যে দুটি খোলা। এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে কাপড়-বই-খাতা। প্লাস্টিকের ৩টি ড্রয়ারবিশিষ্ট একটি ওয়্যারড্রপ। আলমারির পেছনে বোতলের ক্যাপ এবং চানাচুরের খালি প্যাকেটে ভরা। চেয়ারের উপর পড়ে আছে একটি কোলবালিশ। মেঝেতে ময়লা চাদর। এ রুমে শুধু একটি খাট। তবে এতে তোষক বা বিছনা নেই। এ রুমে থাকতেন বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ও মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ইশতিয়াক হাসান মুন্না। তিনি একাই থাকতেন। এটি পার্টি রুম হিসেবে ব্যবহার হতো।
হলটির ৩০১২ নম্বর রুমে থাকতেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। এটির দরজায় তিনটি তালা ঝুলছে। জানালা দিয়ে দেখা যায়, রুমটিতে একটি মাত্র খাট। একটি টেবিল ও একটি উন্নত মানের অফিস চেয়ার রয়েছে। মেঝেতে অত্যাধুনিক ম্যাট। সিগারেটের একাধিক ছাইদানি। পুরো রুমে কোনো বই-খাতা চোখে পড়েনি। রুমটি ছিল এ হলের সর্বোচ্চ দলীয় আড্ডার জায়গা। ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা এ রুমে এসে আড্ডা দিতেন বলে জানা গেছে। ৩০১২ নম্বর রুমটির পেছনের দিকে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দার মতো খালি জায়গা। সেখানে একটি চেয়ার। চারপাশে সিগারেটের অসংখ্য ফিল্টার, খালি প্যাকেট। এক কোনায় ১০টি খালি মদের বোতল। একটি টেবিল লাইট স্ট্যান্ডও আছে।
শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে হলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নিয়োজিত এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, এই তিনটি রুমে এত ময়লা-আবর্জনা হয় যে, হলের সব শিক্ষার্থীর জন্য যে কষ্ট করতে হয়, তার প্রায় সমপরিমাণ কষ্ট হয় এসব রুমে। উনিশ থেকে বিশ হলেই গালমন্দ, চড়-থাপ্পড় খেতে হতো নেতাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঝাড়ুদার বললেন, রুম তিনটিতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা হতো না। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতেন নেতারা। বহিরাগত নেতারাও এ রুমগুলোয় রাত কাটাতেন। প্রতিদিনই ৫-৭টি করে মদের বোতল ফেলতে হতো। নেতারা নির্দিষ্ট টয়লেট ব্যবহার করতেন। ভয়ে অন্য শিক্ষার্থীরা তাদের টয়লেট ব্যবহার করতেন না।
রুম তিনটির পাশের রুমের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে জানান, ওদের (তিন রুমের নেতারা) কারণে আমরা ভালোভাবে পড়াশোনাও করতে পারতাম না। তাদের রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেও ভয় করত। যখন-তখন ডেকে গালমন্দ করত। বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসতে বলত। চা-সিগারেট আনাত। একটু দেরি হলে চড়-থাপ্পড়ও মারত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, রুমগুলোয় নির্যাতনের শিকার অনেক শিক্ষার্থী এসব বিষয়ে জানাত। কিন্তু কী করব, আমাদের তো কিছুই করার ছিল না।
৩০১২ নম্বর রুমটির ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হবে এটি কোনো হলের রুম নয়, কারও ব্যক্তিগত অফিস। মেহেদী হাসান রাসেলের ২০১৭ সালেই পড়া শেষ হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ অবৈধভাবে হলের এ রুমটি দখল করে ছিল সে। মদের আসর বসত। সাউন্ড দিয়ে গান বাজানো হতো। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটত।