নির্দেশনা অমান্য করে বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বুধবার (১৬ অক্টোবর) দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি হিসেবে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করা হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থীদের অলস সময় কাটাতে ক্লাসে বেঞ্চের ওপর মাথা রেখে ঘুমাতে দেখা যায়।
আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, নির্দেশনা অমান্য করে যেসব শিক্ষক আন্দোলনে যুক্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য আন্দোলকারী শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে (ডিপিই) নির্দেশনা দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) বদরুল হাসান বাদল বুধবার বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারপরও আমাদের নির্দেশনা উপেক্ষা করে যে সব শিক্ষক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন এবং হবেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হবে। এজন্য ডিপিইকে নির্দেশনা দেয়া হবে। তাদের শনাক্ত করে চাকরিবিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছেন সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষক। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকদের মোট ১৪টি সংগঠন মিলে সম্প্রতি গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদ’। এ পরিষদের মাধ্যমে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পর গত সোমবার থেকে তারা আন্দোলনে নেমেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের দশম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন দেয়ার দাবিতে গত সোমবার (১৪ অক্টোবর) সারাদেশের প্রায় ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করা হয়। পরদিন দুই ঘণ্টা ও আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন তারা। তাদের এ কর্মসূচি পালনের ফলে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস নেননি শিক্ষকরা।
সকাল থেকেই তারা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি পালন করেন। এ কারণে বুধবার শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ক্লাস না করে ফিরে গেছে। এ সময় কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে বেঞ্চের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে অলস সময় কাটাতে দেখা যায়।
এদিকে ক্লাস না নিয়ে শিক্ষকরা আন্দোলন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। তাওহীদ নামে তৃতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর বাবা আব্দুল সালাম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘সন্তানকে স্কুলে পাঠাই পড়ালেখা শেখার জন্য, কিন্তু স্কুলের স্যাররা তাদের আন্দোলন করেন আর শিক্ষার্থীরা ঘুমিয়ে সময় পার করে। ঘুমানের জন্য স্কুলে যাওয়ার দরকার কী? বাড়িতে বিছানা আছে, প্রয়োজনে বাড়িতে সারাদিন ঘুমালেও কোনো দুশ্চিন্তা থাকে না।’ আগামীকাল থেকে ছেলেকে স্কুলে পাঠাবেন না বলে জানান এই অভিভাবক।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা। এরপরও দাবি আদায় না হলে ২৩ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচিতে যাবেন বলেও জানানো হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষকরা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এদিকে গত ১৩ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) অতিরিক্ত মহাপরিচালক সোহেল আহমেদের স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য নিরসনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে সক্রিয় বিবেচনাধীন। এ পর্যায়ে কোনো ধরনের দাবি আদায়ের কর্মসূচি পালন করা হলে তা সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা বা অংশগ্রহণ করা সরকারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা-২০১৮ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ ধরনের কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
জানা গেছে, এ নির্দেশনা জারির ফলে দেশের কিছু কিছু বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন থেকে বিরত থেকে ক্লাসে নিয়মিত পাঠদান করাচ্ছেন। তবে তাদেরকে আন্দোলনে যুক্ত হতে শিক্ষক নেতৃবৃন্দদের পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। এ কারণে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন বলে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন।
আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ বুধবার বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য নিরসনে প্রাথমিক এবং গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব পাঠানো হলেছিল তাতেও আমাদের দাবির বাস্তবায়ন করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের ১০তম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দিতে আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি করে এলেও এ প্রস্তাবনায় প্রধান শিক্ষকদের ১০তম গ্রেড দেয়া হলেও সহকারীদের ১২তম গ্রেড দিতে বলা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষকদের গ্রেড পরিবর্তনের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
নির্দেশনা অমান্য করে কেন আন্দোলন করা হচ্ছে জানতে চাইলে শামছুদ্দীন মাসুদ বলেন, ‘সারাদেশে প্রায় চার লাখ শিক্ষক আন্দোলনে নেমেছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাদের আশ্বাস দিলেও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষকরা আস্থা হারিয়ে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছেন।’
মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিলে কতজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে- এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারা আন্দালনে নেমেছেন। এখানে প্রায় সারাদেশের পৌনে চার লাখ শিক্ষক যুক্ত রয়েছেন। তাই কয়জনের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে?’
আগামীকালের কর্মসূচির পরও যদি দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আগামী ২৩ অক্টোবরের পর কঠিন কর্মসূচি দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন এই শিক্ষক নেতা।