বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই নাট্যামোদী দর্শকের ঘরোয়া বিনোদনমাধ্যম ছিল শুধু টিভি নাটক। একমাত্র চ্যানেল বিটিভির মাধ্যমে তখন বিনোদনের চাহিদা পূরণ করা হতো। তাই নাটকের সংখ্যাও ছিল সীমিত।
একুশ শতকের শুরুতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার শুরু হলে নাটক নির্মাণের সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে দর্শকের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আগে সাপ্তাহিক নাটক প্রচার হলেও পরে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিদিন নাটক প্রচার করতে শুরু করে। নিত্য-নতুন গল্প, নির্মাণে বৈচিত্র্য এবং দক্ষ অভিনয়শিল্পীদের সমন্বয়ে নাটকগুলো নির্মিত হতে থাকে।
এতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই টিভি নাটকের প্রসার লাভ করতে থাকে। এতে নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মাধ্যমই উপকৃত হতে থাকে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই অভিনয়শিল্পীর পেশায় নাম লেখান। নতুন-পুরাতনের সমন্বয়ে চমৎকার এক মেলবন্ধনের মাধ্যমে টিভি নাটক একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোয় এসে সেই গৌরব হারাতে বসেছে টিভি নাটক। এর জন্য প্রায় সব পক্ষই দায়ী। বাজেট স্বল্পতা, গল্পের দুর্বলতা, আনকোরা অভিনয়শিল্পী নিয়ে কাজ করা এবং লাগামহীন বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণে দর্শক টিভি নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ফলে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এসব দর্শক বিকল্প বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে অনলাইনে ঝুঁকছেন। কারণ সুবিধাজনক সময়ে অনলাইন থেকে নাটক দেখে নিচ্ছেন দর্শকরা। এ ছাড়া একঝাঁক তরুণ নির্মাতার সঙ্গে কিছু নামি নির্মাতাও অনলাইনের দিকে ঝুঁকছেন।
এতে করে টিভি নাটক হয়ে পড়ছে বৈচিত্র্যহীন। শুধু উৎসবকেন্দ্রিক সময়গুলোয় কিছুটা বৈচিত্র্য কিংবা দর্শকের পছন্দের কথা মাথায় রেখে নাটক প্রচারের চেষ্টা করে টিভি চ্যানেলগুলো। এ থেকে উত্তরণের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না টিভি চ্যানেল কিংবা নির্মাতাদের পক্ষ থেকে।
অন্যদিকে কথিত আছে টিভিতে যেসব নাটক প্রচার হয় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন কিছু এজেন্সির কাছে। তারাই গল্প এবং অভিনয়শিল্পী ঠিক করে দিচ্ছেন। এতে করে মানের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। অনেকেই বলেন, বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যই এখন নাটক প্রচার করা হয়। এ নিয়ে দর্শকমহল থেকে শুরু করে প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পীরাও বিব্রত।
তবে প্রথম সারির অভিনয়শিল্পীরাও টিভি নাটক নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। নাট্যাভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু বলেন, ‘অনলাইনে নাটক প্রচারের কারণে কিছু দর্শক টিভি থেকে হয়তো সরে গেছেন।
এটা স্বাভাবিক বিষয়ই মনে হয় আমার কাছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। তবে টিভি নাটককে যেন আরও সময়োপযোগী করা যায়, এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবার কাজ করা উচিত। তরুণ দর্শকের সঙ্গে এখন বয়স্ক দর্শকও কিন্তু অনলাইনে ঝুঁকছেন। টিভিতে নাটক প্রচারকালীন বিজ্ঞাপন প্রচার সীমিত করতে হবে।
টিভি নাটকের এ সময়ে এসে আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে এটার গ্রহণযোগ্যতা আরও নিুমুখী হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থাতেও দর্শকের একটা অংশ কিন্তু টিভি দেখতে চায়।
কাজের মান যদি আমরা ঠিকমতো বজায় রাখতে পারি, গল্প যদি সুন্দর হয় তাহলে টিভি নাটকের দর্শক ধরে রাখা কিংবা দর্শক বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর নাটক তো একটা বাণিজ্যিক মাধ্যমও। শিল্পসম্মত কাজের মাধ্যমে যদি এ বিজনেসটা করা হয় তাহলে সবার জন্যই ভালো হবে।’
দর্শক হারানোর বিষয়টি স্বীকার করে জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ মাধ্যমে কাজ করা লোকদের আন্তরিকতা নেই। যে নাটকের প্রতি আদর থাকবে, টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শকদের প্রতি ভালোবাসা না থেকে যদি বিরতিহীন বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে এবং অভিনয়শিল্পীদেরও যদি কাজের প্রতি দরদ না থাকে, যারা নির্মাতা তাদের যদি দায়বদ্ধতা না থাকে তাহলে এমন অবস্থা তো হবেই। টিভি নাটকের ক্ষেত্রে বেশি অবহেলা করা হচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘টিভি নাটকে দর্শক কমে যাওয়ার নানা কারণ আছে বলে আমি মনে করি। কোন সময়ে নাটক প্রচার হবে সেটাই মানুষ জানে না। এর সঙ্গে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা তো আছেই। এ ছাড়া নাটকের মান নিয়ে তো প্রশ্ন থেকেই যায়। এসব বিষয়ে বহুবার বলা হয়েছে। বাজেট স্বল্পতার কারণে ভালো নির্মাতারা ঠিকমতো নাটক নির্মাণ করতে পারে না। এগুলোর সুরাহা না করলে টিভি নাটকে দর্শকের আগ্রহ কমতেই থাকবে।’
প্রসঙ্গটি নিয়ে নিজেদের বিরক্তির কথা প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকজন টিভি নাটকের দর্শক। গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাজহার রুবেল বলেন, ‘আমি স্কুলজীবন থেকেই টিভি নাটক দেখছি। কয়েক বছর আগেও পছন্দের নাটক দেখার জন্য অন্যান্য কাজ ফেলে নির্ধারিত সময়ে টিভি সেটের সামনে বসে যেতাম। নির্মল আনন্দ পেতাম সেসব টিভি নাটক থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে টিভি নাটকের এ বেহাল অবস্থার কারণে কালেভদ্রে টিভির সামনে বসি নাটক দেখার জন্য। তারপরও বিজ্ঞাপন বিরতির কারণে ধৈর্য ধরে বসে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া দু-তিনটি চরিত্র নিয়ে একটি একখণ্ডের নাটক শেষ করে দেয়া হচ্ছে। এতে করে টিভি নাটক দেখা মানে সময় নষ্ট করা। তাই অনলাইনে পুরনো নাটক দেখে বিনোদিত হওয়ার চেষ্টা করি।’
একই ধরনের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী দর্শক মেসবাহুল ইসলাম মিঠু। তিনি বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই টিভি নাটক দেখি নিয়মিত। ইদানীং সেভাবে আর টিভিতে নাটক দেখা হয় না।
কারণ ঘুরেফিরে একই মুখ দেখা যায় সব নাটকে। গল্পের কোনো আকর্ষণ নেই। মনে হয় কোনো রকমে সময়টা অতিক্রম করার জন্য নাটক প্রচার করা হয়। এসব গড়পড়তা নাটক দেখতে আর ভালো লাগে না। তাই শুধু সংবাদ প্রচারকালীন টিভি দেখা হয়। আর ঈদে পছন্দের কিছু নাটক দেখা হয়।’