দেশের রাজনীতিতে চরম কোণঠাসা জামায়াতের দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। কোনো ধরনের সভা-সমাবেশ শেষ কখন দেখা গিয়েছিল তা দলের নেতাকর্মীরাও হয়তো বলতে পারবে না। শুধুমাত্র প্রেস রিলিজের মাধ্যমে জানা যায় দলটির বিভিন্ন কার্যক্রম।
সম্প্রতি দলটির নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে চলছে তোড়ঝোড়। দীর্ঘ সাড়ে নয় বছরের বেশি সময় জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা মকবুল আহমদও দলের দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার কথা জানিয়েছেন দলের সর্বোচ্চ ফোরামকে।
জামায়াত সূত্র জানায়, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ইতিমধ্যে দলের নির্বাহী পরিষদে অবসরের চিঠি দেন তিনি। পরিষদে তা গৃহীতও হয়েছে। ফলে আগামী ডিসেম্বর থেকে তিনি আর আমির হিসেবে থাকছেন না। তার ছুটি নেয়ায় শুরু হয়েছে আমির নির্বাচন। অনেকেই জানতে চান তাহলে কে হচ্ছেন জামায়াতের পরবর্তী আমির? জানা গেছে, সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রায় আড়াইশ শুরা সদস্য রয়েছে। এসব শুরা সদস্যদের ভোটে তিনটি প্যানেল করা হয়েছে। এই তিন প্যানেলের তিনজন প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকেই জামায়াতের রোকনরা ভোট দেবেন এই তিন প্রার্থীকে।
তবে ওই তিন প্রার্থী ছাড়াও যে কাউকে ভোট দিতে পারবেন রোকনরা। এভাবেই নির্বাচিত হবেন জামায়াতের পরবর্তী আমির।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত তিন প্যানেলে রয়েছেন-জামায়াতের নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, দলটির বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ও আরেক নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। এই তিনজনের মধ্যেই নির্বাচিত হবেন জামায়াতের পরবর্তী আমির।
জামায়াতের একটি ঘনিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আজকালের মধ্যেই সারাদেশের রোকনদের কাছে পৌঁছে যাবে নির্বাচনের ব্যালট। এরপর পর্যায়ক্রমে সারাদেশের রোকনরা ভোট দিবেন। এই ভোট চলবে আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত। একটি সূত্রে জানা যায়, আমির নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ‘কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন’ হিসেবে কাজ করছেন ৪ সদস্যের একটি টিম। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবু তাহের মাছুমের নেতৃত্বে টিমের বাকিরা হলেন জোনাল ইনচার্জ আবদুর রব, অফিস সহকারী আবদুস সাত্তার ও বায়তুল মাল সম্পাদক শাহাবুদ্দীন। এই নির্বাচন ঘিরে আলোচনায় সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা. শফিকুর রহমান ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। তাদের সম্পর্কে অনেকেরই কৌতুহল রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক অবস্থান, সিনিয়রিটি ও সংগঠনের প্রতি দায়বদ্ধতায় যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনিই হতে পারেন জামায়াতের আমির।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের জন্ম রাজশাহীতে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেন।
তিনি ১৯৮৬ সালে রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ইসলাম ও ইসলামী জীবন নিয়ে অনেক বইয়ের প্রণেতাও জামায়াতের সাবেক এ সংসদ সদস্য।
জামায়াত সূত্র জানায়, অধ্যাপক মুজিবুর রহমান জামায়াতের রাজশাহী মহানগরীর সাবেক আমীর, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান সময়ে জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র নায়েবে আমির। বর্তমান জামায়াতের আমির ও সাবেক দুই আমিরের কাছাকাছি থেকেছেন দীর্ঘদিন। জামায়াতের রুকনরা যদি সিনিয়রিটির দিক বিবেচনা করেন তবে অধ্যাপক মুজিবুর রহমানই হতে যাচ্ছেন জামায়াতের আগামী দিনের আমির।
ডা. শফিকুর রহমান
ডা. শফিকুর রহমানের গ্রামের বাড়ি সিলেটের কুলাউড়ার ভাটারা এলাকায়। তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা জাসদ ছাত্রলীগের হাত ধরে।
১৯৭৪ সালে সিলেটের এমসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেন। এরপর সেখান থেকে পাস করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রশিবিরে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে পরবর্তীতে তিনি শিবির সভাপতি নির্বাচিত হন।
পরে শহর ছাত্রশিবিরের সভাপতিও ছিলেন ডা. শফিকুর রহমান।
জামায়াতে আসার পর ডা. শফিকুর রহমান সিলেট মহানগরীর আমীর, অবিভক্ত জেলা আমির এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমানে তিনি সিলেটের একটি মেডিকেল কলেজ ও শিশু হাসপাতালের মালিকদের একজন। তবে জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান খুব একটা সুখকর নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে মৌলভীবাজার-২ আসনে চারদলীয় জোটের মনোনিত প্রার্থী হলেও জামানত বাজেয়াপ্ত হয় তার। এরপর থেকে আর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ দেখা যায়নি তার কাছে। তবে গত নির্বাচনে নিজ এলাকা বাদ দিয়ে ঢাকা-১৫ আসন থেকে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন ডা. শফিকুর রহমান। কিন্তু এখানেও তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তবে মিডিয়া কেন্দ্রিক তার সক্রিয়তা রয়েছে। দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় বিভিন্ন সময় দলের পক্ষে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে বলে শুনা যায়। এ দিকটা বিবেচনা করলে জামায়াতের রুকনরা তাকে ভোট দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তারও আমির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার
জামায়াত সূত্র জানায়, মিয়া গোলাম পরওয়ার ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯ সালে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার শিরোমণি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে বি এল কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে বিকম. ও এমকম. পাশ করার পর অধ্যাপনা ও সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে ছাত্র থাকাবস্থায় জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে ছাত্রশিবিরের খুলনা মহানগরীর সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত খুলনা মহানগরে জামায়াতের আমীর এবং ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ (ফুলতলা-ডুমুরিয়া) আসন থেকে জামায়াতের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সামান্য ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হেরে যান।
সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি ওই আসন থেকে চারদলীয় প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেও জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন। উপরোক্ত তিনজনের কাকে বাদ দিয়ে কাকে ভোট দেবেন এ নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন সারা দেশের রোকনরা। জামায়াতের দাবি, জামায়াত একটি সংঘবদ্ধ দল। এখানে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, পদেরও কোনো লোভ নেই। চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী দল চলে। প্রার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী ভোট দেবেন রোকনরা। এক্ষেত্রে কোনো লবিং গ্রুপিংয়ের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় এক কর্মপরিষদ সদস্য জানান, আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি (জ্যেষ্ঠতা) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জামায়াতে। অতীতেও পদবির সিনিয়রিটি হিসেবেই আমির নির্বাচন করা হয়েছে। বর্তমানে দলের ৪ জন নায়েবে আমির আছেন। তারা হলেন- অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (সাজাপ্রাপ্ত), মিয়া গোলাম পরওয়ার, আ ন ম শামসুল ইসলাম। এখান থেকে যেহেতু দুইজন নায়েবে আমির প্যানেলে আছেন আমার মনে হয়, তাদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত হবেন।
এছাড়া জামায়াতের মজলিসে শুরার এক সদস্য নিজের মতামত ব্যক্ত করে বলেন, দলের সিনিয়রিটি ও যোগ্যতা অনুযায়ী আমির নির্বাচনে প্রাধান্য পায়। সেক্ষেত্রে সাবেক এমপি ও সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মজিবুর রহমানের আমির হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রসঙ্গত, মকবুল আহমাদ জামায়াতের তৃতীয় নির্বাচিত আমির। এর আগে গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী দলটির নির্বাচিত আমির ছিলেন। এর বাইরে বিভিন্ন সময় প্রয়াত আব্বাস আলী খান, মাওলানা আবদুর রহিম দলটির ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্বে পালন করেন। তৃতীয় ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবেও মকবুল আহমদ দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।
জামায়াতের প্রচার বিভাগ থেকে জানা গেছে, মকবুল আহমদ ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, নায়েবে আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি মকবুল আহমদ। দলীয় প্রধান হিসেবে নির্বাচন না করায় দলের ভেতরেও তাকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বলে জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে।