২রা ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বনাম ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ

আপডেট: অক্টোবর ২৮, ২০১৯

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

সাংবাদিকতা হল বিভিন্ন ঘটনাবলি, বিষয়, ধারণা ও মানুষ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি ও পরিবেশন; যা ওইদিনের প্রধান সংবাদ এবং তা সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। এ পেশায় শব্দটি দিয়ে তথ্য সংগ্রহের কৌশল ও সাহিত্যিক উপায় অবলম্বনকে বোঝায়।

মুদ্রিত, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট এবং আগে ব্যবহৃত নিউজরিল সংবাদমাধ্যমের অন্তর্গত।

সাংবাদিকতার যথোপযুক্ত নিয়মের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্নরকম হয়ে থাকে। কিছু দেশে সংবাদমাধম সরকারি হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং পুরোপুরি স্বাধীন সত্তা নয়।

অন্যান্য দেশে সংবাদমাধ্যম সরকার থেকে স্বাধীন; কিন্তু লাভ-লোকসান সাংবিধানিক নিরাপত্তার আওতায় থাকে। স্বাধীন ও প্রতিযোগিতামূলক সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংগ্রহ করার মুক্ত উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে প্রবেশাধিকার জনগণকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে সাহায্য করে।

সাংবাদিকতার ধরন : বিভিন্ন ধরনের পাঠকের জন্য সাংবাদিকতার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। একটি একক প্রকাশনায় (যেমন সংবাদপত্র) বিভিন্ন ধরনের সাংবাদিকতা উপাদান থাকে এবং প্রত্যেক উপাদান বিভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা ওয়েবসাইটের প্রতিটি বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের জন্য সংবাদ সরবরাহ করে থাকে। সাংবাদিকতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধরন হল-

১. ওকালতি-সাংবাদিকতা কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শ বা পাঠকের মতামতের প্রভাব সমর্থন করে লেখা হয়।

২. সম্প্রচার সাংবাদিকতা- বেতার বা টেলিভিশনের জন্য লিখিত সাংবাদিকতা।

৩. নাগরিক সাংবাদিকতা- নাগরিকদের অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা।

৪. উপাত্ত সাংবাদিকতা- ঘটনাবলি সংখ্যায় খুঁজে বের করা এবং তা সংখ্যায় প্রকাশ করার রীতি।

৫. ড্রোন সাংবাদিকতা- ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করা।

৬. গঞ্জো সাংবাদিকতা- হান্টার এস থম্পসন কর্তৃক উদ্ভাবিত গঞ্জো সাংবাদিকতা হল প্রতিবেদন প্রণয়নের নিজস্ব উপায়।

৭. পারস্পরিক ক্রিয়াশীল সাংবাদিকতা- অনলাইন সাংবাদিকতার একটি ধরন, যা ওয়েবে উপস্থাপন করা হয়।

৮. অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা- সামাজিক সমস্যাগুলো উদ্ঘাটন করে এমন প্রতিবেদন।

৯. আলোকচিত্র সাংবাদিকতা- চিত্রের সাহায্যে সত্য ঘটনাগুলো উপস্থাপনের রীতি।

১০. সেন্সর সাংবাদিকতা- অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সেন্সর ব্যবহার করা।

১১. ট্যাবলয়েড সাংবাদিকতা- বিনোদনমূলক সংবাদ প্রণয়ন, যা মূলধারার সাংবাদিকতা থেকে কম বৈধ।

১২. হলুদ সাংবাদিকতা- অতিরঞ্জিত অভিযোগ বা গুজববিষয়ক প্রতিবেদন।

১৩. ক্রীড়া সাংবাদিকতা- ক্রীড়া সাংবাদিকতা অপেশাদার এবং পেশাদার ক্রীড়া খবর ও ঘটনা রিপোর্টের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। ক্রীড়া সাংবাদিক সব প্রিন্ট, টেলিভিশন সম্প্রচার এবং ইন্টারনেটসহ মিডিয়াতে কাজ করে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমের বিকাশের ফলে সাংবাদিকতাকে একটি প্রক্রিয়া না বলে নির্দিষ্ট সংবাদ পণ্য বলে অভিহিত করার বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ বিবেচনায় সাংবাদিকতা হল এক ধরনের অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া; যেখানে একাধিক লেখক ও সাংবাদিক এবং সামাজিকভাবে মধ্যস্থতাকারী জনগণ জড়িত থাকে।

ইতিহাস : ইয়োহান কারোলাসের ১৬০৫ সালে স্ট্রাসবুর্গ থেকে প্রকাশিত রিলেশন অলার ফুর্নেমেন উন্ড গেডেনকভুর্ডিগেন হিস্টরিয়েনকে প্রথম সংবাদপত্র বলে অভিহিত করা হয়। প্রথম সফল ইংরেজি দৈনিক হল ১৭০২ থেকে ১৭৩৫ সালে প্রকাশিত ডেইলি ক্যুরান্ট।

১৯৫০-এর দশকে দিয়ারিও কারিওকা সংবাদপত্রের যে রূপ দিয়েছিলেন তার মাধ্যমে ব্রাজিলে আধুনিক সাংবাদিকতার জন্ম বলে চিহ্নিত করা হয়।

১৯২০-এর দশকে যখন আধুনিক সাংবাদিকতা রূপ ধারণ করতে শুরু করে তখন লেখক ওয়াল্টার লিপম্যান এবং মার্কিন দার্শনিক জন ডিউয়ি গণতন্ত্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। তাদের এ ভিন্ন ভিন্ন দর্শন এখনও সমাজ ও রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা বিষয়ে যুক্তি প্রদর্শনে ব্যবহৃত হয়।

পেশাদারি ও নৈতিক মানদণ্ড : সাংবাদিকতার বিদ্যমান নৈতিক মানদণ্ডে ভিন্নতা রয়েছে। বেশিরভাগ রীতিতেই সত্যতা, সূক্ষ্মতা, বিষয়বস্তুর উদ্দেশ্য, পক্ষপাতহীনতা এবং কৈফিয়ত- এ বিষয়গুলো সাধারণ উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এ উপাদানগুলো সংবাদ করার মতো তথ্য সংগ্রহ করতে এবং জনগণের কাছে প্রচার করতে ব্যবহৃত হয়। কিছু সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিধিতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় বিধিতে সংবাদে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গবিষয়ক এবং শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা নিয়ে বৈষম্যমূলক সূত্র বিষয়েরও অন্তর্ভুক্তি রয়েছে।

আবার কিছু ইউরোপীয় নৈতিকতার বিধিতে সব সংবাদপত্র ইনডিপেনডেন্ট প্রেস স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজেশনের বিধি মেনে চলতে বাধ্য এবং তা যুক্তরাজ্যেও প্রচলিত। এ বিধিতে জনগণের গোপনীয়তাকে সম্মান দেয়া এবং নিখুঁতভাবে কাজ নিশ্চিত করা অন্তর্ভুক্ত।

হলুদ বা উত্তেজনামূলক সাংবাদিকতা : হলুদ সাংবাদিকতা বলতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনকে বোঝায়। এ ধরনের সাংবাদিকতায় ভালোমতো গবেষণা বা খোঁজখবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়।

হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হল, সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শক সংখ্যা বাড়ানো।

অর্থাৎ হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেঙ্কারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি।

ফ্র্যাঙ্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন-

১. সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলামজুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা।

২. ছবি আর কাল্পনিক নকশার অপরিমিত ব্যবহার।

৩. ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার।

৪. সম্পূর্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সঙ্গে সাধারণত কমিক্স সংযুক্ত করা হয়।

৫. স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো; পরাজিত নায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি।

হলুদ সাংবাদিকতাবিষয়ক কার্টুন : স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম হয়েছিল সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে পেশাগত প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে।

এ দুই সম্পাদক তাদের নিজ নিজ পত্রিকার ব্যবসায়িক স্বার্থে একে অপরের অপেক্ষাকৃত যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কর্মচারীদের বেশি বেতনে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। একপর্যায়ে ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে তারা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন।

পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও হার্স্টের নিউইয়র্ক জার্নালের মধ্যে পরস্পর প্রতিযোগিতা এমন এক অরুচিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য আর পাঠকদের উত্তেজনা দানই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

প্রফেসর ড. মো. জাহানগীর কবির : বিভাগীয় প্রধান, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
     
Website Design and Developed By Engineer BD Network