রোদ-বৃষ্টি-ঝড় যা-ই হোক, সাকিবের মনের জোর ছিল অনেক বেশি। এটা বিজ্ঞাপনে সাকিবের মায়ের মুখে বসিয়ে দেয়া সংলাপ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের যিনি সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, তার ওপর দিয়ে এখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এখনও তার মনের জোর অনেক বেশি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষের ভালোবাসার প্লাবন। সেই ঝড় তাকে যতই তিন কাঠির খেলা থেকে ছিটকে দিক, অন্ধকার-অরণ্য চিরে ঠিকই আলোয় ফিরবেন, এ বিশ্বাস তার ভক্তদের।
গত পরশু কার্তিকের নিকষ কালো সন্ধ্যায় ছলছল চোখে সাকিব যখন নিজের ভুল স্বীকার করে আইসিসির শাস্তি মাথা পেতে নেন, সেই ক্ষণ থেকে দেশজুড়ে বইছে আবেগের হাওয়া। আমজনতা থেকে বোদ্ধা, ক্রিকেটখোর থেকে গৃহবধূ- সবার ঠোঁটস্থ তখন এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দু’বছরের জন্য নিষিদ্ধ সাকিবের নাম।
আবেগের ভেলা ভাসিয়ে শহর-বন্দর-গ্রামে, জনপদে-জনারণ্যে টুকরো টুকরো সংলাপে সাকিবের শাস্তি নিয়ে কাটাছেঁড়া। স্কুলফেরত শিশু শিক্ষার্থীকে হালকা রসিকতায় জননী বলছেন, তোমাকে এ এক বছর সাকিব হতে হবে। বাজারে কাঁচামরিচ বিক্রেতার কথায় ঝাঁজ- সাকিবকে ওরা নিষিদ্ধ করেছে। আমরা ভারতে যাব না।
আবেগের বহতা নদী যে মোহনায় এসে মিলিত হয়েছে, তার নাম সাকিব। জীবনের চেয়ে বড় চরিত্র হয়ে ওঠা এ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আড়ালে চলে গেছেন এক বছরের জন্য। নিভৃতচারী হয়ে তার কানে কী পৌঁছবে হাটখোলায়-বাড্ডায় আলোচনায়-আড্ডায় তার জন্য বেশুমার মানুষের আবেগমাখা কথন? যার একটাই শিরোনাম- সাকিবের পাশে বাংলাদেশ।
তার নিজের শহর মাগুরায় কাল বিক্ষোভ মিছিল থেকে স্লোগান দেয়া হয়েছে, ‘নো সাকিব, নো ক্রিকেট, নিষেধাজ্ঞা মানি না, মানব না’। শুধু মাগুরা নয়, গোটা বাংলাদেশে সাকিব এক আবেগের নাম।
বুধবার সকালে এ নগরীর ঘুম ভেঙেছে অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও হতাশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। সব পত্রিকার প্রধান শিরোনামে সাকিব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ধূমায়িত চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেয়ার ফাঁকে ঝড়। মাশরাফি মুর্তজার স্ট্যাটাস, ‘দীর্ঘ ১৩ বছরের সহযোদ্ধার এ ঘটনায় নিশ্চিতভাবে নির্ঘুম কয়েকটি রাত কাটবে আমার।’
১৮ বছর যার সঙ্গে রোদ-ছায়া মেখে ক্রিকেটের ভুলভুলাইয়ার ভুবনে আনন্দ মাখামাখি করেছেন মুশফিকুর রহিম ফেসবুকে তার পোস্ট, ‘বয়সভিত্তিক থেকে আন্তর্জাতিক, ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে তোমার সঙ্গে ক্রিকেট খেলে আসছি। ভাবতেও ভীষণ খারাপ লাগছে যে, মাঠে তোমাকে ছাড়া খেলব।’
ভারতের বিমান ধরার আগে টি ২০ দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ বলে গেলেন, ‘সাকিব কোনো অন্যায় করেনি, ভুল করেছে। ওর অভাব পূরণ হওয়ার নয়। তার অনুপস্থিতিই আমাদের প্রেরণা।’
ভারত সফরে টেস্ট দলের অধিনায়ক মুমিনুল হকের কথায় আবেগ উছলে পড়ে, ‘মনটাই ভেঙে গেছে। সাকিব একজনই। বাংলাদেশের গর্ব।’ তাদের মতো তার সব সতীর্থের মন কাঁদছে সাকিবের জন্য। জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফীস যথার্থই বলেছেন, ‘নিজের ভুল স্বীকার করে সাকিব সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। ওর নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে সবাই হতভম্ব।’
জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকেও ছুঁয়ে গেছে সাকিবের নিষিদ্ধ হওয়ার দুঃখ। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবলের প্রাক-ফাইনাল ম্যাচের সংবাদ সম্মেলনে কাল চট্টগ্রাম আবাহনীর অধিনায়ক জামাল বলেন, ‘সাকিবের জন্য দুঃখিত। তিনি একজন চমৎকার খেলোয়াড় এবং সত্যিকারের নেতা। আমি ক্রিকেট দেখি শুধু সাকিবের জন্য।’
সারা বিশ্বের গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে সাকিবের নিষিদ্ধ হওয়ার খবর। সাবেক ক্রিকেটাররাও জানিয়েছেন তাদের প্রতিক্রিয়া। টুইটবার্তায় রাহুল দ্রাবিড়ের প্রশ্ন, ‘অবিশ্বাস্য! সাকিবের শাস্তিটা বেশি কঠোর হয়ে গেল না? সে কী ফিক্সিংয়ে জড়িত ছিল? তার অপরাধ, আইসিসি ও দুর্নীতি দমন ইউনিটকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব সম্পর্কে জানায়নি। এজন্য দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা একটু বেশিই কঠোর হয়ে গেছে।’
বিরুদ্ধ স্রোতেও গা ভাসিয়েছেন কেউ কেউ। যেমন সাবেক কিউই অলরাউন্ডার স্কট স্টাইরিস আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা এক বছর কমিয়ে দেয়া হল কেন? অন্তত দুই বছরের জন্য বিদায় বলা দরকার ছিল।’
পক্ষে-বিপক্ষে বাহাস চলতেই থাকবে। ক্রিকেট থেকে সাময়িক নির্বাসিত সাকিবের জন্য সবচেয়ে বড় প্রেরণা, গোটা দেশ তার পাশে আছে। এটাই চান সাকিব।
বরাবরের মতো অকুণ্ঠ সমর্থন। সেটার যে কোনো ঘাটতি হবে না, তার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন ক্রিকেট-অনুরাগী দেশবাসী। মাশরাফির কথায়ও সাকিব পেতে পারেন সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা- ‘তার নেতৃত্বেই ২০২৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলব আমরা। কারণ, নামটি তো সাকিব আল হাসান…!!!’