• ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একজন এম.আব্দুল গফুর-বর্তমানেও যাঁর প্রয়োজন ফুরায়নি-দাস গুপ্ত আশিষ কুমার

report71
প্রকাশিত নভেম্বর ৩, ২০১৯, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ণ
একজন এম.আব্দুল গফুর-বর্তমানেও যাঁর প্রয়োজন ফুরায়নি-দাস গুপ্ত আশিষ কুমার

আগামী ৩০ নভেম্বর এম. আব্দুল গফুরের মৃত্যুর ১৭ বছর পূর্ণ হবে। বরিশালের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সামাজিক কর্মকাণ্ডের অজস্র ক্ষেত্রে তিনি অশেষ অবদান রেখে গেছেন। বহুমাত্রিক গুনাবলি নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। মানুষের কল্যাণে তিনি নিজেকে সবটুকু উজার করে দিয়ে গেছেন।

সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ হিসেবে তিনি যৌবনের শুরুতে মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের চরম গণবিরোধী কার্যক্রম তাকে মুসলিম লীগের সাম্প্রসায়িক রাজনীতির ভ্রান্ত পথ থেকে মুক্ত করে প্রগতিশীল রাজনীতির মহাসড়কে যুক্ত করে। আমৃত্যু তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

তাঁর চরিত্রে কয়েকটি গুণ আমি নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করেছি। অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিলেন তিনি। প্রাথমিকে তৎকালে তিনি দুটি শ্রেণিতে বৃত্তি প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে জিলা স্কুলে অসাধারণ মেধাবী ও পণ্ডিত শিক্ষকদের সান্নিধ্যে কাটে স্কুল জীবন। এরপর তৎকালীন বাংলার অক্সফোর্ড খ্যাত বি.এম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ও ¯œাতক শ্রেণির ছাত্র। সেখানেও জুটেছিল মেধাবী ও মানবপ্রেমী সব শিক্ষকের সান্নিধ্য। তবে চল্লিশের দশকের শেষ ভাগে রাজনৈতিক ডামাডোলে সক্রিয় ভাবে জড়িত হওয়ায় বি.এ পরীক্ষায় তাঁর আশানুরূপ ফলাফল অর্জিত হয়নি। তা সত্তে¡ও আমরা তাঁর জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারতাম। তবে অর্জিত এ জ্ঞান তিনি অর্থ-উপর্জানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেননি। যা তিনি জানতেন, তার সবটুকু শিক্ষার্থীদের উজার করে দিতে তাঁর কার্পণ্য বা ক্লান্তি ছিল না। শিক্ষার্থীকে শুধু কোন রকমে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে নেয়া নয়, পরিপূর্ণ আলোকিত এবং বোধ-বৃদ্ধি সম্পন্ন দক্ষ মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। মানব প্রেমের দীক্ষা কখনও তাঁকে লক্ষ্য ভ্রষ্ট করেনি। ধনী-নির্ধন, হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষের ভেদাভেদকে তিনি ঘৃণা করতেন অন্তরের বিশ^াস থেকে। শিক্ষার আলোয় সমাজকে আলোকিত করার এক মহৎ দ্রষ্টা ছিলেন এম. আব্দুল গফুর। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তথাকথিত উচ্চাকাক্সক্ষী হলে তিনি নিজেকে অনেক বড় আমলা বা মন্ত্রীত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। এ ধরণের প্রতিষ্ঠার পথ তিনি সচেতন ভাবেই পরিহার করেছেন।

অত্যন্ত রাজনীতি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। একটি বিশেষ দল বা আদর্শের প্রতি তাঁর আনুগত্য থাকলেও সব দল ও মতের কাছে তিনি ছিলেন গ্রহণযোগ্য। এম. আব্দুল গফুরের শিক্ষা, পেশাগত অবস্থান, পেশা ও রাজনীতিতে তাঁর স্বচ্ছতা এবং নীতিনিষ্ঠতা, নিঃস্বার্থ মানব সেবায় উৎসর্গীকৃত ভাবনা তাঁকে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলো। কঠিন রাজনৈতিক বিধি নিষেধ-নির্যাতনের মধ্যে যখন নানা দল মতের মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে পথ চলার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলনা, তখন ত্রাতা ছিলেন এম.এ গফুর।

সর্বোপরি তাঁর সাহসের কথা বলতে হয়। শুধু সাহস নয় তাঁর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল বিশেষ অফাবহঃবৎড়ঁং বা দুঃসাহসিকতা। তাঁর দুঃসাহসের কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সমাজের লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। অনেক সময় তিনি এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যাতে আমরা চিন্তিত হয়েছি, দ্বিধা দ্ব›েদ্ব ভুগেছি। কিন্তু তিনি দমেননি। তাঁর এমন সাহসের কারণেই শিক্ষা বিভাগের আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের অফিস রক্ষা পেয়েছে। বহুতল বিশিষ্ট সুরম্য শিক্ষক ভবন তৈরি সম্ভব হয়েছে। বি.এড. কলেজ নির্মাণের জটিলতা দূর, বরিশালে শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার নির্মাণ সকল ক্ষেত্রেই তাঁর সাহস ও অগ্রণী ভ‚মিকার স্বাক্ষর রয়েছে। কত কঠিন অবস্থায়ও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ঘাতক দালাল নির্মূলের আন্দোলনের বিরাট দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তা ভাবলে শরীর শিহরিত হয়।

সর্বশেষ কিন্ত প্রথমেই যা বলতে হত তা হল, শিক্ষকদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা, দরদ। এখন শিক্ষকদের চাকুরি কিছুটা নিরাপদ। কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় যখন তখন চাকুরি যাওয়া এখন কিছুটা কঠিন। কিন্তু এক সময় চাকুরির কোন নিরাপত্তা ছিলনা। কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ে যেতে নিষেধ করলেই চাকুরি শেষ। শিক্ষকদের এসব ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অফিস আদালতে যত দৌঁড়াদৌঁড়ি, তিনি ছাড়া এ অঞ্চলে আর কেউ ছিল না। জাতীয় ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর ভ‚মিকা ছিল প্রবাদতুল্য। ইতিহাসের সে সব দিন খুব আরামের ছিল না। কখনো সামরিক আইন, কখনো জরুরি অবস্থা, শিক্ষকদের দাবি দাওয়া জানানোও ছিল কঠিন। সে সব দিনেও সব বিধি-নিষেধের ভয়কে উপেক্ষা করে এম.আব্দুল গফুর এগিয়ে গেছেন। তাঁর সাহসী ভ‚মিকায় শুধু এ অঞ্চল নয়, সারা দেশের শিক্ষক সমাজ অনুপ্রাণিত হয়েছে।

মৃত্যুর ১৭ বছর পূর্তির প্রাক্কালে এ অঞ্চলের সকল শিক্ষক, তাঁর প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সকল শাখাকে গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর সমগ্র জীবনের বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্মরণানুষ্ঠান করার আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি। তিনি আমাদের কাজের প্রেরণা, অন্তরের ধ্র“বতারা। কিংবদন্তিতুল্য এম.আব্দুল গফুরকে গভীর শ্রদ্ধা।