• ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ৫ মিনিট কাঠগড়ায়

report71
প্রকাশিত নভেম্বর ৩, ২০১৯, ১৪:০৪ অপরাহ্ণ
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ৫ মিনিট কাঠগড়ায়

ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করায় চাকরিচ্যুতের অভিযোগে নিজ প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের কর্মীদের দায়ের করা পাঁচ মামলায় আত্মসমর্পণ করে ৫০ হাজার টাকা মুচলেকায় স্থায়ী জামিন পেয়েছেন। এই পাঁচ মামলায় জামিন নিতে শ্রম আদালতের কাঠগড়ায় তাকে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। জামিন পাওয়ার পর মুচকি হেসে এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন তিনি। এসময় তার সাথে ছিলেন গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের কর্মকর্তারা।

রোববার সকাল ১০টায় পাঁচ মামলায় জামিন নিতে শ্রম আদালতে উপস্থিত হন তিনি। এসময় প্রথম শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান শাহজাহানের খাস কামরায় প্রবেশ করেন। খাস কামরায় ড. ইউনূসের সঙ্গে কর্মকর্তারা প্রবেশ করে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। বেলা সাড়ে ১১টার কিছুক্ষণ পর প্রথম শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান তার খাস কামরা থেকে এজলাসে ওঠেন। ওই সময় ড. ইউনূস বিচারকের খাস কামরায় বসেছিলেন।

দুপুর ১২টার দিকে ড. ইউনূস দ্বিতীয় শ্রম আদালতে আত্মসমর্পণ করতে যান। আদালতে গিয়ে তিনি পেছনের টেবিলে বসেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে সবার সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এসময় দ্বিতীয় শ্রম আদালতের বিচারক জাকিয়া পারভীন এজলাসে উঠেন (তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক ছুটিতে থাকায় দ্বিতীয় আদালতে শুনানি হয়)।

পেশকার ড. ইউনূসের পাঁচ মামলা শুনানির জন্য ডাকেন। এসময় ড. ইউনূসকে কাঠগড়ায় যেতে বলা হয়। তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বসার জায়গায় দাঁড়াতে বললেও এজলাস থেকে আবারও বলা হয় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে। ১২টা ৫ মিনিটে তিনি মলিন মুখে কাঠগড়ায় ওঠেন। তখন তার আইনজীবীরা বলেন, ড. ইউনূস সম্মানিত ব্যক্তি। বয়সেও প্রবীণ। এসব বিবেচনায় তার জামিন মঞ্জুর করা হোক। আদালত তখন পাঁচ মামলায় ৫০ হাজার টাকা মুচলেকায় তার স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর তার আইনজীবী ২০৫ ধারায় আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরার একটি আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করেন এবং তাকে অভিযোগ গঠন শুনানির দিন উপস্থিত হতে বলেন।

দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে তিনি কাঠগড়া থেকে আবারও প্রথম শ্রম আদালতের খাস কামরায় চলে যান। সেখানে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। ১২টা ৪০ মিনিটে খাস কামরা থেকে বের হন। পাঁচ মিনিট পর আদালত চত্বর ত্যাগ করেন।

প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করায় চাকরিচ্যুতের অভিযোগে দায়ের করা পাঁচ মামলায় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্থায়ী জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর মধ্যে তিন মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। অপরদিকে একই আদালতে দায়ের করা আরও দুই মামলায় তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। ৫ নভেম্বর এই দুই মামলার দিন ধার্য থাকলেও বিদেশে প্রোগ্রাম থাকায় অগ্রিম জামিন আবেদন করেন ড. ইউনূস।

রোববার ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাকিয়া পারভীনের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন তিনি। শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেক মামলায় ১০ হাজার টাকা করে মোট ৫০ হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।

সেই সঙ্গে আগামীতে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেয়ার অনুমতি চেয়েও আবেদন করেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদ। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে অভিযোগ গঠন শুনানির দিন তাকে উপস্থিত হতে বলেন।

এর আগে ২৮ অক্টোবর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আগামী ৭ নভেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও খোন্দকার দিলুরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। একই সঙ্গে বিমানবন্দরে নামার পর থেকে তাকে এই সময়ের মধ্যে (৭ নভেম্বর পর্যন্ত) গ্রেফতার বা হয়রানি না করার নির্দেশ দেন আদালত।

গত ৯ অক্টোবর ট্রেড ইউনিয়নের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগের মামলায় শান্তিতে  নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক রহিবুল ইসলাম। আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে সময় চেয়ে ড. ইউনূসের পক্ষে আবেদন করা হয়।

গত ৩ জুলাই ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের সদ্য চাকরিচ্যুত সাবেক তিন কর্মচারী। আদালত ৮ অক্টোবর তাদের হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করেন। অপর দুজন হলেন একই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজনীন সুলতানা ও উপ-মহাব্যবস্থাপক খন্দকার আবু আবেদীন।

৮ অক্টোবর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু ওইদিন পূজার বন্ধ থাকায় পরদিন (৯ অক্টোবর) মামলাটির শুনানি হয়। ওইদিন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজনীন সুলতানা ও উপ-মহাব্যবস্থাপক খন্দকার আবু আবেদীন আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। অপরদিকে ড. ইউনূস আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

অপরদিকে একই অভিযোগে হোসাইন আহমেদ ও আব্দুর গফুর নামে গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের দুই কর্মী ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও দুই মামলা করেন। মামলা দুটির জন্য আগামী ৫ নভেম্বর দিন ধার্য ছিল।

যারা মামলা করেছেন

১. আব্দুস সালাম, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার চড়াইকোল গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। তিনি প্রস্তাবিত গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ২০০৫ সালের ২৭ জুন গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সে স্থায়ী পদে জুনিয়র এমআইএস অফিসার (কম্পিউটার অপারেটর) হিসেবে যোগদান করেন তিনি।

২. শাহ আলম, নীলফামারী জেলার এলাহী মসজিদপাড়ার নজরুল ইসলামের ছেলে। প্রস্তাবিত গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক তিনি। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সে স্থায়ী পদে জুনিয়র এমআইএস অফিসার (কম্পিউটার অপারেটর) হিসেবে যোগদান করেন।

৩. এমরানুল হক, হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল থানার নারিকেলতলা গ্রামের সফর আলীর ছেলে। তিনি প্রস্তাবিত গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্য। তিনি ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সে স্থায়ী পদে জুনিয়র এমআইএস অফিসার (কম্পিউটার অপারেটর) হিসেবে যোগদান করেন।

৪. হোসাইন আহমেদ, গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের কর্মী।

৫. আব্দুর গফুর, গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের কর্মী।

যে অভিযোগে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা

মামলার বাদীরা গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সে স্থায়ী পদে এমআইএস অফিসার (কম্পিউটার অপারেটর) হিসেবে কাজে যোগদান করেন। শ্রমিক হিসেবে নিজেদের সংগঠিত হওয়া ও নিজেদের কল্যাণের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী নিজেরা অন্যান্য শ্রমিক সহকর্মীর সঙ্গে নিয়ে ‘গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (প্রস্তাবিত)’ নামে একটি ইউনিয়ন গঠন করেন এবং তা আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেন।

২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল ট্রেড ইউনিয়নটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য মহাপরিচালক ও রেজিস্টার অব ট্রেড ইউনিয়নে আবেদন করা হয়। ৯ জুন তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

মামলার বাদী আব্দুস সালাম প্রস্তাবিত ওই ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, শাহ আলম প্রচার সম্পাদক ও এমরানুল হক সদস্য। তাদের অভিযোগ, আসামিরা ইউনিয়নের বিষয় জানতে পারলে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকেন। স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনেও বাধা প্রদান করেন। অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করায় প্রকাশ্যে হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন আসামিরা।

আসামিদের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার বেআইনিভাবে বাদীদের প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজ থেকে বিরত রাখেন এবং কোনো কারণ ছাড়াই তাদের চাকরি থেকে টার্মিনেট করেন। বিষয়টি তারা লিখিতভাবে শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালকে অবগত করেন। পরে কাজের বিষয়ে বহুবার যোগাযোগ ও অনুনয়-বিনয় করলেও তাদের (বাদীদের) প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে দেয়া হয়নি।

শুধু ইউনিয়ন গঠন করার কারণে আসামিরা তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করে কাজ থেকে বিরত রাখেন এবং বেআইনিভাবে চাকরিচ্যুত করেন।

ইউনিয়ন করার কারণে চাকরিচুত্যির বিষয়টি সম্পূর্ণ বেআইনি বিধায় চলতি বছরের ২৩ জুন আসামি নাজনীন সুলতানা ও খন্দকার আবু আবেদীন বরাবর রেজিস্টার্ড ডাকযোগে তারা অনুযোগপত্র পাঠান। সেখানে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা তাদের প্রতিষ্ঠানে ইউনিয়ন গঠনের কারণে বাদীদের বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১৯৫ (ঘ) ধারা লঙ্ঘন এবং অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেছে। বাদীরা শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩১৩ ধারার তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য ও ইউনিয়ন গঠন এবং তার কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩৯১ (১) ধারা মোতাবেক মামলা করতে বাধ্য হয়েছে।

সারাদেশে আইটি সেবা দেয় গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের কর্মীরা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত (ISO 9001 : 2015) সার্টিফায়েড, গ্রামীণ ব্যাংকের একমাত্র আইটি প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স’। সারাদেশে ২৫৬টি তথ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র এ আইটি সেবা দিয়ে থাকে। গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সে এক হাজার কর্মী রয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হওয়ায় সবার মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। কমিউনিকেশন কর্তৃপক্ষ বারবার মৌখিক আশ্বাস দিয়েও তা বাস্তবায়ন করেনি।

গত ১৬ এপ্রিল প্রায় ৫৫০ জন কর্মী সংগঠিত হয়ে ঢাকার শ্রম অধিদফতরের ট্রেড ইউনিয়নের শাখায়, ‘গ্রামীণ কমিউনিকেশন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন’ (প্রস্তাবিত)-এর আবেদন জমা দেন।