নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুলি’র হাত থেকে দেশের উপকুলীয় এলাকার বিশাল জনপদ রক্ষায় উপকুলীয় বনভূমি এবারো ‘প্রকৃতিক ঢাল’ হিসেবে কাজ করেছে। অতীতে ‘সিডর’, ‘আইলা’ ও ‘মহাসেন’র মত বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় সমুহ প্রতিহত করতে দেশের বিশাল উপকুলীয় বনভুমি যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করে। রবিবার ভোর ৪ টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলি ভারতÑবাংলাদেশের মধ্যবর্তি সুন্দরবন এলাকায় প্রথম আঘাত হানার সময় এর তীব্রতা ছিল ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটারের মত। কিন্তু সুন্দরবনে আছড়ে পড়ে ক্রমে পূর্বÑউত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বরিশাল পর্যন্ত পৌছতে ঝড়টির তীব্রতা ৭৯ কিলোমিটারে হ্রাস পায়। এপথ পরিক্রমায় বুলবুলিকে প্রতিহত করে উপকুলীয় বনভুমি। সুন্দরবন ছাড়াও একের পর এক উপকুলীয় বনভুমির ওপর আঘাত হানতে গিয়ে বুলবুলি ক্রমে দূর্বল হতে থাকে। ফলে আরো একবার একটি বড় ধরনের প্রকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকুল ভাগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে কার্যকর ভুমিকা পালন করে উপকুলীয় বন। তবে এবারের বুলবুলি’র আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা সহ উপকুলীয় বনের প্রায় সহ¯্রাধিক হেক্টর ক্ষতিগ্রস্থও হয়েছে। সিডর’র আঘাতেও উপকুলভাগের সংরক্ষিত বন সহ ব্যক্তি মালিকানাধীন বনের প্রায় এককোটি গাছ বিনষ্ট হয়। তার পরেও এ ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ই সিডরকে আগাগোড়া প্রতিহত করেছিল।
ঘূর্ণিঝড়Ñজলোচ্ছ্বাস সহ এধরনের প্রকৃতিক দূর্যোগ মানুষের নিয়ন্ত্রনের বাইরে। কিন্তু আগাম সতর্কতা যেমনি এসব দূর্যোগের হাত থেকে জানমাল রক্ষায় সহায়ক হয়, তেমনি উপকুলীয় বনায়ন যেকোন মাত্রার ঝড়-জলোচ্ছাসের তীব্রতা হৃাসে ইতোপূর্বেও কার্যকর ভুমিক রেখেছে। ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাকÑদূর্যোগ প্রস্তুতি সহ উপকুলীয় বনায়ন যথেষ্ট গতি লাভ করে।
সরকার বঙ্গোসাগরের কোল ঘেসে ৭১০ কিলোমিটার উপকুলীয় তটরেখার ১৯টি জেলার ৪৮টি উপজেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘উপকুলীয় এলাকা’ হিসেবে চিহিৃত করেছে। যা দেশের মোট আয়তনের ৩০%। মোট জনসংখ্যার ২৮% মানুষ এসব ঝুকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে। এসব এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী সহ সম্পদকে রক্ষায় ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে সীমিত বনায়ন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রকল্প ও দাতাদের সহায়তায় উপকুলভাগে এ পর্যন্ত দুই লক্ষাধীক হেক্টর জমিতে ‘লবনাম্বুজ বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে। সরকারের নিজস্ব তহবিল ছাড়াও বিশ^ব্যাংক সহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় পর্যায়ক্রমে উপকুলীয় বনায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন’ নামে আরো একটি প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে নতুন বনায়নসহ এক হাজার কিলোমিটার উপকুলীয় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন ধরনের সড়কে বৃক্ষ রোপনের একটি প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। বরিশাল বিভাগের ৪টি জেলাসহ উপকুলের মোট ১০টি জেলায় আগামী চার বছওে এ বনায়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হবে।
বন অধিদপ্তরের কোষ্টাল সার্কেলের হিসেব অনুযায়ী দেশের উপকুলভাগে এ পর্যন্ত প্রায় ২লাখ হেক্টরে লবনাম্বুজ বন, সাড়ে ৮ হাজার হেক্টরে মূল ভুমির নন-ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বন, প্রায় ৩ হাজার হেক্টরে গোলপাতা, ২শ হেক্টরে বাঁশ ছাড়াও একশ হেক্টরের মত নারকেল সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার উপকুলীয় বাঁধ সহ বিভিন্ন ধরনের রাস্তার ধারে ১ লাখ ২০ হাজার বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগান হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বনভ’মির কারনে দেশের বিশাল উপকুলীয় এলাকায় ইতোমধ্যে অনেক ভুমি উদ্ধারও সম্ভব হয়েছে। অনেক চরাঞ্চল মূল ভু-খন্ডের সাথেও যূক্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে পরিবশেবীদদের মতে ভু-খন্ড উদ্ধারের চেয়েও এসব সৃজিত বনভুমি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক ভুমিক রাখছে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়-জলোচ্ছাসের হাত থেকে উপকুলভাগকে রক্ষায়।
এযাবতকাল উপকুলীয় এলাকায় যে বনায়ন করা হয়েছে, তার ৯৪%-ই ছিল কেওড়া গাছ। কিন্তু এসব গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হলেও দশ বছর বয়স থেকে কান্ড ছিদ্রকারী পোকার আক্রমনে কেওড়া বাগান মড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি উপকুলীয় বাগানে ক্রমাগত পলি পড়ে ভ’মির উচ্চতা বৃদ্ধি সহ অবাধে গবাদিপশুর বিচরনে বনভুমির মাটি শক্ত হয়ে বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রানে উপকুলীয় এলাকায় কেওড়া’র বিকল্প হিসেবে ‘ছইলা,বাইন, সাদা বাইন, মরিচা বাইন, গেওয়া, সুন্দরী, পশুর, ধুন্দল, সিংড়া, খলসী, কিরপা, গোলপাতা, হেতাল, কাকড়া, গড়ান ও গর্জন’ গাছের চারা উত্তোলন ও আবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ বন গবেষনা ইনস্টিটিউট।
এছাড়াও উপকুলীয় এলাকায় তাল গাছের চাড়া উত্তোলন ও রোপনের একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে ইনস্টিটিউট। তালগাছ যেকোন প্রকতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে যেমনি টেকসই, তেননি তা বজ্রপাতের হাত থেকে জানমাল রক্ষাও যথেষ্ঠ কার্যকরি বলে জানা গেছে।