সাঈদ পান্থ ॥ কলংকিত হলো বরিশালের ঐতিহ্যবাহি অক্সফোর্ড মিশনের ধর্মীও পবিত্র স্থান। মিশনের দুইটি স্কুলের প্রায় কোটি টাকা স্কুল ফান্ড থেকে উধাও হয়ে গেছে। মিশনের ফাদার ফ্রান্সিস পান্ডেকে সামনে রেখে ফাদার জন হালদার এই অপকর্ম করেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফাদার ফ্রান্সিস পান্ডে প্রায় ৪০ বছর ধরে সুনামের সাথে এই মিশনের দ্বায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানের তিনি বৃদ্ধ হওয়ায় নতুন করে গত ২০১৫ সালের জুলাই মাসে জন হালদার ফাদার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ফাদার জন হালদার ফাদার হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নানা বির্তকিত কর্মকান্ড ঘটে এই মিশনে।
জানা গেছে, চার্চ অব বাংলাদেশের আওতাধীন ও মালিকানাধীন অক্সফোর্ড মিশন এপিফানি গীর্জা। ফাদার জন হালদার ও তার অনুসারী কয়েকজনকে নিয়ে একটি ভিন্ন ট্রাস্ট গঠন করে অত্র চার্চের জমি হস্তান্তরের চেষ্টা চালায়। এ ঘটনায় এই চার্চের মডারেটর বিশপ ও ডেপুটি মডারেটর বিশপসহ সিনট কমিটির হস্তক্ষেপে তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর পর দৃষ্টি পরে অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুল ও প্রাইমারীর উপর। চার্চের নিয়ম অনুযায়ী দুইটি স্কুলেরই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হবেন মডারেটর বিশপ। সে অনুযায়ী যুগের পর যুগ স্কুল দুইটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। দীর্ঘ বছর ধরে এই মিশন ঢাকা ডায়োসিস এর আওতায় ছিল। কিন্তু সদ্য বরিশালে আলাদা ডায়োসিস ঘোষনা হওয়ায় এখানে ডেপুটি মডারেটর বিশপ হিসেবে নিয়োগ পান সৌরভ ফলিয়া। সে অনুযায়ী দুইটি স্কুলেরই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হন ডেপুটি মডারেটর বিশপ সৌরভ ফলিয়া।
কিন্তু সৌরভ ফলিয়া দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই নতুন ফাদার জন হালদারের কুট-কৌশলে অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুলের হিসাব পরিচালনার জন্য ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে বাদ দিয়ে প্রধান শিক্ষক, ফাদার ফ্রান্সিস পান্ডে ও ফাদার জনকে মনোনীত করেন ফাদার ফ্রান্সিস পান্ডে। যা তারা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে করেছেন। সৌরভ ফলিয়া ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হওয়া সত্বেও স্কুল ফান্ড থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে তারা মোট ৭৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৭৬ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা ফাদার ফ্রান্সিস ও জন এর বিরুদ্ধে ডেপুটি মডারেটর বিশপ সৌরভ ফলিয়া কাছে গত ১৮ নভেম্বর সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। যদিও ফান্সিস ও জন ম্যানেজিং কমিটির কোন পদে নেই। তবে তারা নিজেদেরকে ম্যানেজিং কমিটির উপদেষ্টা হিসিবে জাহির করে নানা অপকর্ম করছেন। তিনি জন হালদারের প্ররোচনায় অর্থ উত্তোলন, বিদ্যালয় পরিচালনায় ও সকল ক্ষেত্রে একক সিদ্ধান্ত গ্রহন করছেন। এমনকি এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতিকেও অবহিত করেন না।
সর্বশেষ বিদ্যালয়ের ফান্ট থেকে গত ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর ১০ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী ১৫ লাখ টাকা সেন্টার অফিস ট্যান্সফার নামে উত্তোলন করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের গ্রাচ্যুইটি বন্ধ করে দিয়েছেন ফাদার ফ্রান্সিস। যদিও এই ফান্টে ৬ লাখ টাকার বেশী রয়েছে বলে শিক্ষকরা জানান। এদিকে এইসব অপকর্মের সংবাদ দৈনিক আজকের পরিবর্তনে প্রচারের পর দুই ফাদার স্কুলের শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসতে চাইলে গতকাল বুধবার স্কুলের সকল শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ব্যাতিত অন্য কারো সাথে সভা করতে রাজি নয় মর্মে প্রধান শিক্ষক বরাবর লিখিত আবেদন করেন।
একইভাবে অক্সফোর্ড মিশন প্রাইমারী স্কুলের সভাপতি ডেপুটি মডারেটর বিশপ সৌরভ ফলিয়াকে স্কুলের ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলন করে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন জন হালদার ও ফান্সিস পান্ডে। পরে সৌরভ ফলিয়া ব্যক্তিগত ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর প্রভাব খাটিয়ে ফাদার ফ্রান্সিসকে সামনে রেখে (ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে) স্কুলের সভাপতি হন বিতর্কিত ফাদার জন হালদার। জন হালদার স্কুলের ফান্ড থেকে ২২ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। তবে এই টাকা স্কুলের কোন কাজে ব্যবহার করা হয়নি বলে স্বীকার করেছেন স্কুলের শিক্ষকরা।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মেরি রায় জানান, স্কুলের ফান্ড থেকে ২২ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এই টাকা স্কুলের জন্য ব্যায় করা হয়নি।
এ বিষয়ে ফাদার ফ্রান্সিস পান্ডের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিতর্কিত ফাদার জন হালদার বলেন, ‘হাইস্কুল থেকে যে ভাবে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সেই ভাবেই প্রাইমারীর টাকাও জেনারেল ফান্ড করার জন্য উত্তোলন করা হয়েছে। আর টাকা উত্তোলনের আগে ম্যানেজিং কমিটি দিয়ে পাশ করা হয়েছে। হাইস্কুলের টাকা উত্তোলনের বিষয়ে পূর্বের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পাশ করে গেছেন।’ চার্চ অব বাংলাদেশের সাবেক মডারেটর ও হাইস্কুলের সাবেক সভাপতি বিশপ পল শিশির সরকার বলেন, ‘যা পাশ করা হয়েছে তা রেজুলেশনে রয়েছে। ৭৪ লাখ টাকার বিষয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। তবে সে সময়ে স্কুলের হোস্টেল ভবন নির্মানের জন্য আমি ২০ লাখ টাকা পাশ করে আসছিলেন। বাকি টাকার বিষয়ে আমার জানা নেই।’
অক্সফোর্ড মিশন হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও অক্সফোর্ড মিশন প্রাইমারী স্কুলের সাবেক সভাপতি ডেপুটি মডারেটর বিশপ সৌরভ ফলিয়া বলেন, ‘আমি ব্যস্ততার কারণে প্রাইমারী স্কুলের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছি। আমি ওই কমিটিতে নেই, তাই সব কিছু জানি না। তবে হাই স্কুলের ফান্ড থেকে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছি।
বরিশাল জেলা শিক্ষা অফিসার মো: আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘এ ঘটনায় ইতামেধ্যে সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তদন্ত স্বাপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির কেউ আমাকে লিখিত ভাবে বিষয়টি জানাননি। তবে বিষয়টি আমি খোজ খবর নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বরিশাল আঞ্চলিক পরিচালক প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি পত্রিকার মাধ্যমে আমার নজরে এসছে। এমপিওভূক্তি স্কুলকে অবশ্যই সরকারি বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করে দেখবো।’ ##