১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

শিরোনাম
তেলবাহী লড়ি উল্টে গিয়ে আগুন লেগে এক জনের মৃত্যু। ভূমি বিষয়ক তথ্যাদি স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করো হয়েছে-ভূমিমন্ত্রী মির্জা ফকরুলরা তারেক জিয়ার নির্দেশে জনগনের সাথে প্রতারনা ও তামশা করছে-আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিগ বার্ড ইন কেইজ: ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার  ঢাবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ১ কোটি টাকার বৃত্তি ফান্ড গঠিত হাইকোর্টের রায়ে ডিন পদে নিয়োগ পেলেন যবিপ্রবির ড. শিরিন জয় সেট সেন্টার’ থেকে মিলবে প্রশিক্ষণ, বাড়বে কর্মসংস্থান: পীরগঞ্জে স্পীকার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস আগামীকাল টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদি মোহম্মদ আর নেই

অবশেষে হাতিরঝিলে দূষিত পানি-উৎকট গন্ধ

আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০১৯

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

জল-সবুজে ঘেরা হাতিরঝিল এক টুকরো স্বস্তি হয়ে এসেছিল নগরবাসীর জন্য। উদ্বোধনের পর এটি বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। হাঁটাহাঁটি, ঘুরে বেড়ানোর জন্য রাজধানীর নানা প্রান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন এখানে। দিনে
দিনে সবুজে ঘেরা প্রকল্পটি সবুজতর হলেও লেকের পানি মানুষের জন্য অস্বস্থির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে এখানে নগরবাসীকে এখন নাক চেপে শ্বাস নিতে হয়। অনেকটা দমবদ্ধ অবস্থায় চলাফেরা করতে হয় লেক পাড় এবং সড়কে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই অস্বাভাবিক খারাপ অবস্থায় লেকের পানি। ড্রেন নালা ও স্যুয়ারেজের পানি আর ময়লা পড়ে কালো হয়ে গেছে পানি। পানিতে ভাসছে নানা বর্জ্য। অতিমাত্রায় পানি দূষিত হয়ে পড়ায় হাতির ঝিলে চলা ওয়াটার বাসের যাত্রীরাও বিপাকে পড়ছেন।

পানি পরিশোধনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় হাতিরঝিলের পানির গুণগত মান ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। পয়নিষ্কাশনের ময়লা, আবর্জনা ও ড্রেনেজের নোংরা পানি এসে বিবর্ণ হয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে ঝিলে। চারপাশে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অসহনীয় দুর্গন্ধে দুর্ভোগে পড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দা, পথচারী ও দর্শনার্থীরা। পরিবেশবিদরা বলছেন, এই দুর্গন্ধযুক্ত পানি জীববৈচিত্র ও পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। গতকাল সরজমিনে হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে, ঝিলের প্রায় সব অংশ থেকেই পচা পানির দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তবে ঝিলের মগবাজার ও এফডিসি অংশে এই দুর্গন্ধ ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। এই অংশে পানিতে ময়লা আর শেওলার আস্তরণ জমে কোথাও কালচে, কোথাও নীলচে, আবার কোথাও সবুজ রং ধারণ করেছে। দর্শনার্থী ও এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, বর্ষার সময় ছাড়া বছরের প্রায় সব সময়ই হাতিরঝিলের পানিতে গন্ধ থাকে। পানির দুর্গন্ধ ও ময়লা-আবর্জনায় ঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। হাতিরঝিল এলাকা দিয়ে চলাচল করা খুবই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শীতকালে লেকের পানি থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়ায়। এতে নানা রোগজীবাণু সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ঝিলে পানি আটকে থাকায় ক্রমেই পানির রং কালো হয়ে পড়ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও হাতিরঝিলের সৌন্দর্য দেখতে ও ঝিল এলাকায় ঘুরতে আসেন বহু দর্শনার্থী। আর সকাল-সন্ধ্যায় নিয়মিত ব্যায়ামও করতে আসেন আশপাশের এলাকার অনেক মানুষ। অথচ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে গড়ে ওঠা বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিলের পরিবেশ দিনদিন নষ্ট হচ্ছে। গুলশান লেক, কারওয়ানবাজার ও বেগুনবাড়ী দিয়ে হাতিরঝিলের পানিতে প্রতিনিয়ত ঢুকছে ময়লা পানি। দূষিত পানির ওপর দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করেছে ওয়াটার ট্যাক্সি। এ থেকে সৃষ্ট ঢেউয়ের কারণে আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় নাকাল দর্শনার্থী-পথচারী ও আশপাশের বাসিন্দারা। এছাড়া পানিতে সব সময় পচা ময়লা-আবর্জনা ভাসতে দেখা যায়। পথচারী ও দর্শনার্থীরা বলছেন, বুকভরে নিশ্বাস নিতে তারা হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন। কিন্তু ঝিলের পানির পচা গন্ধে তারা অতিষ্ঠ।

হাতিরঝিল প্রকল্পের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, আশপাশের বাসাবাড়ির গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা, দর্শনার্থীদের ফেলা বিভিন্ন খাবারের উচ্ছিষ্ট, চানাচুর ও চিপসের প্যাকেট, পানির বোতলসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা লেকের পানিতে ভাসছে। হাতিরঝিলের চারপাশে গড়ে ওঠা দোকান ও রেস্তোরাঁর ময়লাও ফেলা হচ্ছে ঝিলের পানিতে। কয়েকটি ড্রেন দিয়ে আশপাশে এলাকার পচা আবর্জনা ঝিলে প্রবেশ করে নষ্ট করছে পানির স্বচ্ছতা। এ পানি অনেক দিন ঝিলে আটকে থাকায় ক্রমেই পানির রং কালো হয়ে বাড়ছে দুর্গন্ধ। বাতাসের সঙ্গে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ঝিলপাড় ও আশপাশের এলাকায়। ময়লা পানির ঘনত্বে ঢেউয়ে সৃষ্টি হচ্ছে সাদা ফেনার। একই চিত্র দেখা মেলে এফডিসি মোড়, বেগুনবাড়ি লেকপাড়, গুদারাঘাট, নিকেতন ও রামপুরা অংশের এলাকায়। ওয়াটার ট্যাক্সিতে এফডিসি ঘাট থেকে রামপুরায় আসা যাত্রী আশিকুজ্জামান বলেন, মাঝে মধ্যেই ওয়াটার ট্যাক্সিতে করে চলাচল করি। মাঝে বেশ কিছুদিন লেকের পানি ভালো ছিলো।

তবে বর্তমানে দুর্গন্ধের কারণে যাতায়াতে মারাত্মক ভোগান্তি হচ্ছে। ঝিলের পানি কমলে দুর্গন্ধ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে। প্রতি বছর আমরা একই দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। পানি শোধনের ব্যবস্থা না করলে পরিবেশ আরও হুমকির মুখে পড়বে। হাতিরঝিলের রাস্তায় চলাচলকারী আলাউদ্দিন বলেন, দুর্গন্ধের কারণে চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। এছাড়া পানিতে বিভিন্ন ধরনের ময়লা ভাসতে দেখা যায়। দুর্গন্ধের কারণে ওয়াটার ট্যাক্সিতেও যাতায়াতে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে। একই অভিযোগ করেন অন্য দর্শনার্থীরাও। লেকের পাশে বসে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ইয়াছির আরাফাত জানান, সবাই মিলে হাতিরঝিলে আড্ডা দিতে এসেছি। কিন্তু পানির দুর্গন্ধে এখানে থাকাই কষ্টকর।

স্কুল থেকে শিশুকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় হাতিরঝিল হয়েই মধুবাগ যেতে হয় শারমিন আখতারকে। তিনি বলেন, হাতিরঝিলের পরিবেশ খুব খারাপ হয়ে গেছে। ময়লা দুর্গন্ধে বসা তো দূরের কথা। হাঁটাও যায় না। আমি বাচ্চা নিয়ে বাসা যাই এই পথে। প্রতিদিনই এই ময়লা গন্ধ নাকে আসে। একদিন তো আমার বাচ্চাটা বমিই করে দিয়েছে। এত সুন্দর একটা জায়গা। অথচ মানুষ যদি আসতেই না পারে তাহলে কি দরকার করার।

হাতিরঝিলের মগবাজার অংশের লেকের পাশে নিয়মিতই আড্ডা জমান সাইফ ও তার বন্ধুরা। কিন্তু গত কিছুদিন যাবৎ এখানে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। লেকের পানির দুর্গন্ধের কারণে কিছুতেই বসতে পারেন না। সাইফ বলেন, সন্ধ্যায় অফিস শেষ করে বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই এখানে আসতাম। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে হাতিরঝিলে সন্ধ্যার আড্ডা বন্ধ করে দিয়েছি। এত বাজে গন্ধ যা নাকে যেতেই বমি আসে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ইশতিয়াক জানান, ভার্সিটিতে যাওয়া আসায় খুব কষ্ট হয়। এত দুর্গন্ধ যা অস্বস্তিকর। হাতিরঝিল যারা পরিচালনা করেন তাদের উচিত খুব দ্রুত একটা ব্যবস্থা নেয়া। এখানে অনেকে ঘুরতে আসেন। ঢাকার বাইরে থেকেও আসেন। এমন পরিস্থিতি হলে সুন্দর এই জায়গাটায় সবাই আসা বন্ধ করে দিবে। সোহানা নামের আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস শেষে এখানেই আড্ডা দিতে আসি। গত কয়েকদিন যাবত আর আড্ডা হয় না।

ঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সির এ্যাডমিন অফিসার রুবেল হোসাইন ও ঘাট ইনচার্জ হাদিয়ার রহমান জানান, প্রতিবছর শীতকালে যখন পানি কমে যায় তখন দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। আস্তে আস্তে এই দুর্গন্ধ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এতে আমাদের যাত্রীরা অভিযোগ করে। অনেকে দুর্গন্ধের কারণে ওয়াটার ট্যাক্সিতে উঠতে চায় না। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে আমরা কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখি না। তবে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকরা ঝিলের ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় না। কারণ আশপাশের নোংরা পানি এখানে আসে। পানি থেকে ছেঁকে ময়লাগুলো তুলে ফেলা হয়। কিন্তু ময়লা তুললে কি হবে পানিতো নোংরা। নোংরা পানি ঝিলের পানির সঙ্গে মিশে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা বলেন, পানি শোধনের আধুনিক ব্যবস্থা করার কথা শুনি কিন্তু কার্যকর করতে দেখি না। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় পানি শোধনের আধুনিক ব্যবস্থার কথা বলা ছিলো। তাছাড়া আশপাশের ময়লা ও নোংরা পানি এখানে প্রবেশের কথা ছিলো না।

এই নোংরা পানির কারণে হাতির ঝিলের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। প্রকল্প শুরুতে আমাদের ধারণা ছিলো এটি বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার দর্শনার্থীরা এখানে ভিজিট করবেন। প্রকল্পটি ভালোভাবে বাস্তবায়ন হলে হাতিরঝিল দেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হতে পারতো। সবমিলিয়ে এই প্রকল্পটি নিয়ে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিলো তা পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, এখন যে ময়লা আবর্জনা ঝিলের ভেতর প্রবেশ করেছে তা আগে পরিস্কার করতে হবে। এটা করতে খুব কষ্ট হবে না। পরে ময়লা যেন ঝিলে প্রবেশ না করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পানি শোধনের আধুনিক ব্যবস্থার কথা আমরা শুনেছি তা বাস্তবায়ন করতে হবে। হাতিরঝিলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত কর্তৃপক্ষও। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পানি থেকে ময়লা সরানোর কাজও চলছে। এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী এবং হাতিরঝিলের সমন্বিত প্রকল্প পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, এ বিষয়টি আমরা অবগত। ময়লা সরানোর কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করেছি। কি কারণে এ অবস্থা জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী বলেন, সুয়ারেজের পানির প্রবেশ ও আশপাশের ময়লা ফেলায় হাতিরঝিলের পানিতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কবে নাগাদ এই সমস্যার সমাধান হবে তা জানিয়ে রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, আমরা এর মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
     
Website Design and Developed By Engineer BD Network