ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত এক বছরেও শেষ হয়নি।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ভবনে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার এক বছর পার হলেও পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
চার্জশিট দিতে পারেনি। লাশগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তিনটি লাশের পরিচয়ও মেলেনি।
চকবাজারের নন্দকুমার সড়কের মোড়ে চুড়িহাট্টায় ওইদিন রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ভবনে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা অবৈধ কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ আগুনে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেট কার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন পুড়ে যায়।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। নিমেষে চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ।
এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নারী-পুরুষ পুড়ে মারা যান। অনেকে মারাত্মক দগ্ধ হন। এ ঘটনার পরদিন এলাকার বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় মামলা করেন।
মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়।
৭ এপ্রিল হাসান ও শহীদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে তারা জবানবন্দি দেন।
মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবীর হোসেন বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ ৭১ জনের ময়নাতদন্ত শেষ করতে পারেনি।
এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেলেও তাদের ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আশপাশের কেউ তাদের ঠিকানা দিতে পারছে না। তাদের নাম-ঠিকানা নিশ্চিত না হয়ে চার্জশিট দেয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে মারা যাওয়া চারজনের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে গেছে পরিবার।
মৃত ৭১ জনের মধ্যে ৬৭ জনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এখনও তিনজনের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি। দাবিদার থাকলে ও স্বজনরা ডিএনএর নমুনা দিলে মরদেহের ডিএনএর সঙ্গে পরীক্ষা করে শনাক্ত করা যেত।
তিনি বলেন, ডিএনএ রিপোর্টের কারণে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে দেরি হয়েছে। যে কোনো সময় পুলিশের হাতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হবে।
আদালত সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নয়টি তারিখ পার হয়েছে। এ জন্য আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখ ধার্য রয়েছে।
মামলার বাদী আসিফের অভিযোগ- মামলা তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তাকে জানানো হয় না। আগুনে পুড়ে আসিফের বাবা জুম্মন মারা গেছেন।
আসিফ বলেন, এক বছর অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও বিচার পেলাম না।
এমনকি সরকার কিংবা অন্য কারও পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো খোঁজখবরও নেয়া হয় না।
চকবাজার এলাকার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার পুরোটা পাইকারি ও খুচরা প্লাস্টিক জিনিসপত্রের কাঁচামালের দোকান ও গোডাউন ছিল।
বিভিন্ন প্রসাধনীর গোডাউনও ছিল সেখানে। এলাকাটা মূলত প্লাস্টিক কাঁচামালের দোকান ও গোডাউন।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়।
বারবার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও তেমন বদলায়নি পুরান ঢাকার দৃশ্যপট। ঘনবসতিপূর্ণ আর ঘিঞ্জি এলাকার অনেক বাসাবাড়ির নিচে এখনও ঝুঁকিপূর্ণভাবে নানা ধরনের কেমিক্যাল সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে।
অনেক বাসার নিচে গুদামও রয়েছে। অনেকেই বলছেন, দ্রুত দৃশ্যপট না বদলালে হয়তো বারবার এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
গত বছর চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার বিভিন্ন অংশ থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরানোর দাবি নতুন করে আলোচনায় আসে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
কমিটিগুলোর সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়া এবং অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।
কিন্তু সব সময় প্রধান বাধা আসে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেই। নানা যুক্তি দেখিয়ে তারা সেখান থেকে কারখানা সরাতে চান না।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় এ মুহূর্তে প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক এবং প্লাস্টিক কারখানা ও গুদাম আছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল হালিম জানান, ঢাকার কাছে পোস্তগোলা ও টঙ্গীতে চকবাজারের রাসায়নিকের প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্থায়ীভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তবে এগুলো স্থায়ীভাবে সরাতে আরও বছরখানেক সময় লাগবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এগুলো স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেয়া যাবে।
অগ্নিকাণ্ডের পর তাৎক্ষণিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে চকবাজারের কয়েকশ’ রাসায়নিকের কারখানা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও সেখানে ২৪০টির বেশি প্লাস্টিক কারখানা ও গুদাম রয়েছে চকবাজার এলাকায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার হিসাবমতে, দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্পকারখানায় ২৬টির বেশি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ।
হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে দুটি অগ্নিকাণ্ডের মামলা হয়েছে।
এসব দুর্ঘটনায় প্রশাসন কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায়ও আনা হয়নি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালিকপক্ষের অবহেলায় বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি অনেক বেড়েছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে চকবাজার মডেল থানার চুড়িহাট্টা শাহি জামে মসজিদের সামনে প্রাইভেট কারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়।
এতে পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে আগুন লাগে।
এ সময় পাশে আরেকটি প্রাইভেট কারে আগুন লাগে। এতে সেই গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডারও বিস্ফোরিত হয়।
এতে নন্দকুমার দত্ত রোডের চুড়িহাট্টা বিল্ডিংয়ের সামনে সিলিন্ডারভর্তি পিকআপে আগুন লাগলে সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়।
এতে বাড়ির নিচতলা ও রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে আগুন ধরে যায়।
ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত মজুদ বডিস্প্রে, পলিথিনের দানা ও কেমিক্যালে আগুন ধরে যায়।
ভয়াবহ আগুনে ৬৭ জন ঘটনাস্থলে মারা যায়।
এ ঘটনায় স্থানীয় আসিফ মামলা করেন।
মামলায় দুই আসামির নাম উল্লেখ করা হয়।
গত বছরের ১৬ এপ্রিল আসামি হাসান ও শহীদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
বর্তমানে তারা জামিনে আছেন।