অর্থ পাচারে জড়িতদের বিষয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে এবার দুদকের একটি উচ্চপর্যায়ের টিম সিঙ্গাপুর যাচ্ছে।
পর্যায়ক্রমে একাধিক টিম যাবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্য। এসব দেশে অর্থ পাচারকারীদেরও তালিকা হচ্ছে।
কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহে পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের উচ্চপর্যায়ের টিম প্রথম ধাপে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে।
টিমের সদস্যরা ইতিমধ্যে ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছেন।
এছাড়া টেন্ডারবাজি, অবৈধ দখল, সরকারি কাজে প্রভাব বিস্তার, উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিংসহ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধে জড়িত সন্দেহে ইতিমধ্যে অন্তত ১৫০ জনের একটি তালিকাও করেছে সংস্থাটি।
এর বাইরে আরও প্রায় শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে।
এরা নানাভাবে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত।
যাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মানি লন্ডারিং মামলাও হয়েছে।
সিঙ্গাপুর গিয়ে এদের বিরুদ্ধেও সরেজমিন তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাবে টিম।
এদিকে, দুদক ও সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে ক্যাসিনো তালিকার অনেকের বিরুদ্ধেই অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে।
সেই অর্থের সন্ধান, পাচার সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা যাচাইসহ জড়িতদের বিদেশের জীবন, ব্যবসা ও অন্যান্য কার্যক্রম সরেজমিন তদন্ত করতে চায় দুদক।
এতে এফবিআই ও ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া হবে। এমনটিই জানিয়েছেন দুদকের এক মহপরিচালক।
তিনি বলেন, আমরা বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে কয়েক ধাপে তথ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছি।
প্রথমত, ঋণের নামে কারা অর্থ পাচার করেছে।
দ্বিতীয়ত, ইনভয়েস-ওভার ভয়েসের আড়ালে কোন কোন ব্যবসায়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারে জড়িত।
তৃতীয়ত, ব্যাংক ঋণ ও পণ্য আমাদানি-রফতানি ছাড়াও অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নেয়া অর্থ দেশে না রেখে কারা দেশের বাইরে পাচার করেছে, তা নিশ্চিত করা।
এই তিন ক্যাটাগরিতে অর্থ পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করেছে দুদক।
ওই কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, মামলায় সামান্য কিছু অবৈধ সম্পদের তথ্য এসেছে।
তবে এজাহারে ধারণা দেয়া হয়েছে, তদন্তকালে খতিয়ে দেখা হবে দেশের বাইরে সম্রাট কী পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
সেই অর্থের অংশ এক হাজার কোটি টাকা হলেও তা মামলার চার্জশিটে যুক্ত করা হবে।
সম্রাটের মতো যাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে, সেই তথ্য সংগ্রহে দুদকের টিম দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, যারা দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করে ভাবছেন, নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন, তা হতে দেয়া হবে না।
দুদকের হাতে যতটুকু আইনি ক্ষমতা আছে পুরোটাই প্রয়োগ করা হবে। আমাদের টিম এ নিয়ে নানাভাবে কাজ করছে। তথ্য সংগ্রহ করছে।
তিনি দুদকের মানি লন্ডারিং মামলার বিচারের ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলেন, শতভাগ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে।
এখনও রায় হচ্ছে। এসব মামলায় জড়িত অনেক দুর্নীতিবাজ পাচারকারী দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে।
তাদের দেশে ফেরত আনার জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি।
সূত্র জানায়, দুদকের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী, মানি লন্ডারিং বিভাগের পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী, ব্যাংক ও আর্থিক খাত বিভাগের পরিচালক বেনজির আহমেদ ও বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ-১-এর পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের সমন্বয়ে আরও পৃথক চারটি টিম সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে।
দুদকের মানি লন্ডারিং শাখা থেকে সিঙ্গাপুরে চিঠি পাঠিয়ে পাচারকারীদের বিষয়ে বিগত পাঁচ বছরের তথ্য চাওয়া হয়েছিল।
সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোয় গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের যে ব্যক্তিরা জুয়া খেলেছেন তাদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে তথ্য চাওয়া হয়।
দেশটির রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থা করাপ্ট প্র্যাকটিসেস ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর পরিচালক বরাবর গত বছরের ৩১ অক্টোবর ওই চিঠি পাঠিয়েছিলেন দুদকের মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) আ ন ম আল ফিরোজ।
সূত্র জানায়, ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দুদক কিছু তথ্য পেয়েছে, বিশেষ করে কারা সে দেশে ক্যাসিনো ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করেছে, কারা খেলেছে, দেশের টাকা সে দেশে নিয়ে ঢেলে দিয়ে এসেছে, তাদের কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নয় সংস্থাটি।
তারা চায় পূর্ণাঙ্গ তথ্য। সবার নাম। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা রাজনীতির দাপট দেখিয়ে যারা অবৈধভাবে দেশের টাকা সে দেশে নিয়ে গেছে তাদের ধরতে চায়।
সে কারণে দুদকের ক্যাসিনো সংক্রান্ত টিম প্রথম দফায় সিঙ্গাপুর যাচ্ছে।
দেশটি ঘুরে তথ্য সংগ্রহের পর তারা এসে কমিশনকে রিপোর্ট করবে- কী পেয়েছে বা কোনো তথ্য না পেলে বাধা কোথায়, তাও জানাবে।
দুদকের পক্ষ থেকে অর্থ পাচার ও সরকারি অর্থ আত্মসাতে জড়িতদের বিষয়ে তালিকা চেয়ে এনবিআর, সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে চিঠি দেয়া হচ্ছে।
অর্থ পাচারকারীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতেই বিভিন্ন দফতর থেকে তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থসহ অপরাধীদের দেশে ফেরত আনার বিষয়ে দুদক জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের ৪৮ ধারার অধিকার প্রয়োগ করবে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ সংক্রান্ত সনদে ওই দেশগুলো সই করেছে।
কনভেনশনে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার মধ্যে আইনি কার্যক্রমে সহযোগিতার কথা উল্লেখ আছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অনুসারে দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তারা স্বীকার করেছেন, সিঙ্গাপুরে বিপুল অর্থ পাচার করে সেখানের ক্যাসিনোগুলোয় জুয়া খেলেছে।
সে কারণে সিঙ্গাপুরেই প্রথম টিমটি পাঠাচ্ছে দুদক।
গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে অনেকেই গ্রেফতার হন।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ দেশের বাইরে অর্থ পাচারের তথ্য মেলে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেক রাঘববোয়ালের নাম উঠে আসে।
তাদের অর্থ পাচারের দিকটায় দুদক এখন কঠোর নজর দিয়েছে।