২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

শিরোনাম
তেলবাহী লড়ি উল্টে গিয়ে আগুন লেগে এক জনের মৃত্যু। ভূমি বিষয়ক তথ্যাদি স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করো হয়েছে-ভূমিমন্ত্রী মির্জা ফকরুলরা তারেক জিয়ার নির্দেশে জনগনের সাথে প্রতারনা ও তামশা করছে-আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিগ বার্ড ইন কেইজ: ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার  ঢাবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ১ কোটি টাকার বৃত্তি ফান্ড গঠিত হাইকোর্টের রায়ে ডিন পদে নিয়োগ পেলেন যবিপ্রবির ড. শিরিন জয় সেট সেন্টার’ থেকে মিলবে প্রশিক্ষণ, বাড়বে কর্মসংস্থান: পীরগঞ্জে স্পীকার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস আগামীকাল টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদি মোহম্মদ আর নেই

ক্রেতাদের ভ্যাট রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাচ্ছে তো?

আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২১

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) পণ্যের উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে আরোপ ও আদায় করা হলেও এর দায়ভার চূড়ান্তভাবে পণ্য বা সেবার ভোক্তাকে বহন করতে হয়। একজন ভ্যাট গ্রাহকের বা ভোক্তার দায়িত্ব হলো কোনো পণ্য ক্রয় করে বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রয় রসিদ সংগ্রহ করা।

কারণ, যদি ভোক্তা মূসক চালান গ্রহণ করেন, তাহলে নিশ্চিত হয় ভোক্তার প্রদেয় ভ্যাট রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে ক্রেতাদের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় ভ্যাট আদায় করা হলেও তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের পকেটেই রেখে দেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।

এ ধরনের প্রতারণা বা হোয়াইট কলার ক্রাইমের কারণে সরকার শত শত কোটি টাকার ভ্যাটপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। বলা বাহুল্য, মূসক আরোপের মাধ্যমে আবগারী শুল্ক, বিক্রয় কর ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা দূর হয়েছে।

দেশে ১৯৯১ সালে প্রথম মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রথমে অল্প কিছু পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনের ওপর মূসক আরোপ করা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ পণ্য এবং বেশ কিছু সেবা-পরিষেবা, আমদানি, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় ইত্যাদি মূসকের আওতায় আনা হয়েছে। কালক্রমে মূসক সরকারের কর রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মূল্য সংযোজন করের হার নির্ধারণ এবং এর আদায় ও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্বে নিযুক্ত।

ক্রেতাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক নিজেদের পকেটে রেখে দেওয়ার বিভিন্ন বাস্তব প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি। যদিও এ অবস্থা দেশে অনেক আগে থেকেই চলে আসছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এনবিআরের ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় ৮০০ রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে প্রায় ১ হাজার ৬৭ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করেছে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তা জমা দেয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটির ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার উপরে, যা রীতিমতো বিস্ময়কর।

ভ্যাট গোয়েন্দারা সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিমি সুপার মার্কেট, রাজধানীর মৌচাক মার্কেট, পিংক সিটি, নিউমার্কেট, গাউছিয়ায় অভিযান চালিয়ে এমন শতাধিক দোকানের খোঁজ পেয়েছেন, যেসব দোকানের এ পর্যন্ত ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি।

যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অথবা মূসক আইনের অধীনে মূসক উৎসে কর্তনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে কোনো উপায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকি দেন, অথবা কর ফাঁকি প্রদানে সহায়তা করেন, অথবা মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১-এর যে কোনো ধারা, বা মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা ১৯৯১-এর যে কোনো বিধি, বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রণীত অন্য কোনো বিধিমালা বা আদেশ, বা অন্য কোনো মূসক দপ্তরের আদেশ লঙ্ঘন বা ভঙ্গ করেন, তবে তা মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কোনো ব্যক্তি কর ফাঁকি বা আইনের কোনো ধারা, কোনো বিধি বা কোনো আদেশ ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে অপরাধের ধরন অনুযায়ী নিুোল্লিখিত এক বা একাধিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান মূল্য সংযোজন কর আইনে রয়েছে- ১. পণ্য বা সেবা আটক ও বাজেয়াপ্তি; ২. জরিমানা আরোপ; ৩. অপরিশোধিত করের ওপর সুদ আদায়; ৪. সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অঙ্গন তালাবদ্ধকরণ; ৫. মূসক নিবন্ধন বাতিলকরণ; ৬. অবৈধ রেয়াত বাতিল বা সমন্বয়করণ; ৭. গ্রেফতার করা ও কারাদণ্ড প্রদান; ৮. সম্পত্তি অবরুদ্ধকরণ, ক্রোক, বাজেয়াপ্তকরণ ইত্যাদি। উল্লেখ্য, কর ফাঁকির ক্ষেত্রে এসব শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ফাঁকিকৃত কর পরিশোধ করতে হয়।

এনবিআরের মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা কর্তৃক অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বড় মাপের অনেক অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানই বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের মূল্যের সঙ্গেই ভ্যাট আদায় করে। অথচ তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিচ্ছে, যা রীতিমতো অন্যায়, প্রতারণা এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই ইসিআর মেশিন বা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন ব্যবহার করে। বলা বাহুল্য, কোনো বিক্রির তথ্য এসব মেশিনে না দিলে এর কোনো প্রমাণ থাকে না। ভ্যাট ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠান বিক্রির তথ্য মেশিনে না দিয়ে তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দেয়। ক্রেতা যদি বিক্রেতাকে রসিদ দিতে বাধ্য করে, তবে মেশিনে প্রমাণ থাকবে-যা এনবিআরের তদন্তে ধরা পড়বে। জনগণের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করেও শেষ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে প্রকারান্তরে ক্রেতাদের আমানতের খেয়ানত করছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী।

আর এ ধরনের অসাধু ও ফাঁকিবাজ ব্যবসায়ীদের কারণে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মূলত ভ্যাট ফাঁকিবাজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই দুই ধরনের হিসাব রাখে। অনেকে ভ্যাট ফাঁকি দিতে আয়-ব্যয়, বিক্রি ও মুনাফার মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম ভ্যাট পরিশোধ করে রিটার্ন জমা দেয়।

অনেক সময় এনবিআর কর্মকর্তারা ওইসব প্রতিষ্ঠানে অভিযানে গেলে তারা এসব মিথ্যা হিসাব দেখিয়ে থাকে। একই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের সুবিধার জন্য গোপনে প্রকৃত আয়-ব্যয়, বিক্রি মুনাফা ও ভ্যাট পরিশোধের তথ্য সংরক্ষণ করে। প্রকৃত হিসাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল আমদানি ও ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্যের মিল থাকে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, সারা দেশে ভ্যাট প্রদানে সক্ষম বিক্রয়কেন্দ্র প্রায় ৫০ লাখ। অথচ এনবিআরে ভ্যাট নিবন্ধিত বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে। আর মোট ভ্যাট আদায়ের ৫৬ শতাংশই পরিশোধ করে ১৩০ থেকে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান।

এ কথা সত্য, লোকবলের অভাবে এনবিআরের পক্ষে সব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য খতিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। ফলে সব প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে ভ্যাটের তথ্য যাচাই করাও সম্ভব হয় না। আবার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অভিযানে যাওয়া এনবিআরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে অনৈতিক সুবিধা দিয়েও ভ্যাট ফাঁকির তথ্য গোপন করার সুযোগ পেয়ে থাকে, যা বন্ধ করা প্রয়োজন।

অসাধু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কতিপয় অসাধু এনবিআর কর্মকর্তা-এ দুই ক্ষেত্রেই সরকারের নজরদারি বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি ভ্যাট আদায়ের সার্বিক কার্যক্রমকে সর্বদা সচল ও গতিশীল রাখতে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাকে সক্রিয় রাখতে এনবিআরে দ্রুত সৎ, দক্ষ ও যোগ্য জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন।

আশার কথা, ভ্যাট গোয়েন্দারা ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে আগের চেয়ে অভিযান বাড়িয়েছেন এবং সারা দেশেই এ অভিযান চলছে। পাশাপাশি ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে এনবিআর ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাতিল করে অনলাইনে গেছে, ভ্যাট প্রদানে সক্ষম সব প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। রাষ্ট্রীয় আইন প্রতিপালনকল্পে কর প্রদান করা একজন নাগরিবের নৈতিক দায়িত্ব। দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থেই তা প্রয়োজন।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য; সহযোগী সদস্য, সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব গ্লোবাল হিউম্যান মুভমেন্ট, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাজ্য)

kekbabu@yahoo.com

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
     
Website Design and Developed By Engineer BD Network