আপডেট: জুন ৫, ২০২১
বিষাক্ত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে “খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১” চূড়ান্তকরণের কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সে উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় ২০ মে তারিখে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এবং ৩০ মে তারিখে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিনিধিদের সাথে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত করেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূত্র বলেছে যে খুব শীঘ্রই প্রবিধানমালাটি চূড়ান্ত করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মারফত আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং এর জন্য পাঠানো হবে।
ছোট বড় সব বয়সের মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্য ট্রান্সফ্যাট পরিহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (টিএফএ) বা ট্রান্সফ্যাট মানব স্বাস্থ্যের জন্য একটি বিষাক্ত এবং অযাচিত খাদ্য উপাদান। ট্রান্সফ্যাট এক ধরণের ফ্যাট বা স্নেহ জাতীয় খাদ্য উপাদান যা রক্তের এলডিএল বা “খারাপ কোলেস্টেরল” বৃদ্ধি করে, অপরদিকে এইচডিএল বা “ভালো কোলেস্টেরল”-এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ উচ্চহারে হৃদরোগ, হৃদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ (ডিমেনশিয়া) এবং স্বল্প স্মৃতিহানি (কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট) জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে হৃদরোগীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ও মৃত্যু ঝূঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও, যা বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামেই সুপরিচিত। সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে পিএইচও বা ডালডা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও বা ডালডা ব্র্যান্ডসমূহের মোট ২৪টি নমুনা বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফল বলেছে ৯২ শতাংশ নমুনায় ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ ২% মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।
শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি অর্থাৎ সকল ফ্যাট, তেল এবং খাবারে প্রতি ১০০ গ্রাম ফ্যাটে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ গ্রামে সীমিত করা, অথবা পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল- পিএইচও’র উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী সকল তেল, চর্বি এবং খাদ্যে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট এর সীমা বেঁধে দিয়ে তা সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কার্যকর করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। “খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১”-এ বলা হয়েছে রুমিন্যান্ট বা প্রাণিজ উৎসজাত টিএফএ বাদে চর্বির ইমালসনসহ যেকোনো তেল ও চর্বি, যা এককভাবে বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বা যেকোনো খাদ্যের উদ্দেশ্যে অথবা খুচরা ব্যবসা, ক্যাটারিং ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, প্রতিষ্ঠান, বেকারি বা যেকোনো খাদ্য স্থাপনার খাদ্য প্রস্তুতের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং প্রক্রিয়াজাত, মোড়কাবদ্ধ, সরাসরি আহার্য খাদ্য (রেডি-টু-ইট) অথবা যেকোনো খাদ্যে ২ শতাংশের বেশি অর্থাৎ প্রতি ১০০ গ্রামে ২ গ্রামের অধিক টিএফএ থাকলে তা বিক্রয়, বিতরণ, সংরক্ষণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং আমদানি করা যাবে না। এছাড়া, মোড়কজাত খাদ্যের লেবেলে অবশ্যই ট্রান্স ফ্যাটি এসিড ও পিএইচও সম্পর্কিত তথ্য ঘোষণা করতে হবে।
খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে প্রণীত খসড়া প্রবিধানমালাকে অবিলম্বে চূড়ান্ত করার দাবী জানিয়ে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)-এর নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, “ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব করা যাবেনা কোনো অজুহাতে। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূল হলে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যু থেকে অনেকাংশে রেহাই পাবে এদেশের সকল স্তরের মানুষ।” এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত বৃদ্ধির মাধ্যমে ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে Heart Health Alert BD