বরিশাল ব্যুরো
অবশেষে দীর্ঘ ৫ বছর ৮ মাস পর বরিশাল শিল্পকলা একাডেমি ভবনের নির্মান কাজ শেষ হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে নির্মান কাজ শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় কেটে গেছে প্রায় ৬ বছর। ভবনের নির্মান কাজ শেষ হলেও মান নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের মাঝে। তাদের ভাষায় ভবনটি পূর্নাঙ্গ শিল্প চর্চার জন্য উপযোগি নয়। সাধারন আচার অনুষ্ঠানের জন্য যেমন তেমন হলেও নাট্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য একাডেমিক ভবনটি পরিপূর্ন ভাবে তৈরি হয়নি। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে নির্মান কাজ শেষ হলেও সাধারন বেশ কিছু সুবিধার অভাব রয়েছে। এ সকল অপূর্ণতা দুর করে ভবনটিকে সাংস্কৃতিক চর্চার পূর্ণাঙ্গ রুপ দেয়ার দাবীতে কর্মসুচি দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন। অপূর্ণতা নিয়েই আগামী নভেম্বর থেকে ভবনে জেলা শিল্প কলার নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন একাডেমির দায়িত্বশীল সূত্র।
বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবনের কাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জান নূর। ডিভিশনাল এবং জোনাল শিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় কার্যাদেশ ৪১/২(৬) অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারী ভবন ও অডিটরিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রকল্প অনুয়ায়ী ৫০০টি আসন, একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, আর্ট গ্যালারি নামে একটি অডিটোরিয়ামসহ শিল্প সাংস্কৃতিকের বিভিন্ন বিভাগের যাবতীয় সুবিধা রয়েছে। ২০১৭ সালের জুন মাসে ভবন হস্তান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু দফায় দফায় কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। বাকি নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পূর্ন করার আশ্বাসে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশালে সফরকালে বিভাগের অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে এই শিল্পকলা একাডেমি ভবন ও অডিটোরিয়াম উদ্বোধন করেন। পরে নির্মাণকাজে ধীরগতির কারনে স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীদের আমন্ত্রণে ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর সকালে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করেন। মন্ত্রী ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ সমাপ্ত করে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেন প্রকল্প কর্মকর্তা ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু সেই নির্দেশনা আমলে নিয়ে নির্ধারিত সময়ে কাজটি সমাপ্ত করতে পারেনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইনফিনিটি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এর পরে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আবার বন্ধ হয়ে যায় কাজ। কাজ বন্ধ থাকায় খুলে পরে অডিটরিয়ামের সিলিং। এর দেড় বছর পরে কাজটি প্রায় সমাপ্ত হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নতুন করে সিলিং তৈরি সহ অন্যান্য কাজ দায়সারা ও নিম্নমানের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছে তাদের মতো করে। ভবন নির্মান নিয়ে সংস্কৃতি কর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ থাকলেও ঠিকাদারের ভাষায় কাজ শেষ। তারা এখন হস্তান্তরের অপেক্ষায় রয়েছেন। এ বিষয়ে বরিশাল শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার হাসানুর রশিদ মাকসুদ জানান, অনেক অপেক্ষার পর কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ শেষ হয়েছে প্রায়। ভবন, অডিটরিয়াম, অডিটরিয়ামে ডিজিটাল সাউন্ড ও লাইটিং, এলইডি মনিটর সংযোজন এর কাজ হয়েছে। গত ২৭ আগষ্ট কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনে এসেছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপার্ট টিম। তারা কাজ এর অগ্রগতি পরিদর্শন করে গেছেন। কাজ শেষ হলেও কাজে বেশ কিছু অসম্পূর্নতা রয়েছে। কালচারাল অফিসার বলেন, একাডেমির অডিটরিয়ামে যে লাইটিং করা হয়েছে তা মূলত নাটকের উপযোগি লাইটিং নয়। এছাড়া এই সাউন্ড ও লাইটিং এর অপারেটিং একটু জটিল। এর জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ অপারেটর। এসব ম্যানুয়ল না হওয়ায় কোন সমস্য দেখা দিলে তা মেরামত সম্ভব নয়।
তিনি জানান, চায়না থেকে আনা এ সকল লাইটে সমস্যা দেখা দিলে তা পুরোপুরি পাল্টাতে হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আগামী এক বছর সার্ভিসিং এর দায়িত্ব নিলেও তা পরবর্তিতে একটি সমস্যার বিষয়ে পরিনত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অডিটরিয়ামের সিলিং এর স্থানে ভালো মানের জিপসাম বোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা ভালোর স্থানে ভবনটির বাম পাশের দেয়ালে সমস্যা হবে। কারন বর্ষায় একাডেমির ভবনের বা, পাশের দেয়ালে নোনা ধরে ভিজে ওঠে। আর জিমসাম বোর্ড মানে ভালো হলেও ওজনে বেশ ভারি হয়। তাই এর আগের ন্যায় নোনার কারনে সিলিং এর বোর্ড খুলে পড়তে পারে। তবে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা আর ঘটবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। একাডেমির সীমানা প্রাচীর আরও উচু হলে ভালো হতো বলে জানিয়ে বলেন, এতে একাডেমিক ভবন অরক্ষিত রয়েছে। দেয়াল উচু হলে আশ-পাশের বসতি থেকে দেয়াল টপকে একাডেমির মধ্যে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যক্রম করা যেত না। এছাড়া পুরো ভবনে কোথাও স্থাপন করা হয়নি সিসি টিভি ক্যামেরা। এটি একটি ভালো সমস্যা বলেন তিনি। এ সকল বিষয় ইতিমধ্যে পরিদর্শনে আসা এক্সপার্ট টিমের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানান হাসানুর রশিদ মাকসুদ। গনপূর্ত বিভাগ নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে এ অভাব পূরনে ব্যবস্থা গ্রহন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
কিছু আসবাব এর কাজ শেষ হলেই বর্তমানের অস্থায়ী ও জরাজীর্ণ কার্যালয় ছেড়ে নতুন শিল্প কলা একাডেমিতে স্থানান্তরিত হবে। তা আগামী মাসেই হবে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজে একাডেমির উদ্বোধন করেছেন তাই আর কোন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে না। স্থানান্তরিতের পর নিয়মিত কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে শিল্পকলা একাডেমির নতুন ভবন তার যাত্র শুরু করবে। আর শুরুর মাধ্যমে অনেকটা সমৃদ্ধ হবে শিল্পকলা। বেশ ভালো সুবিধা ভোগ করতে পারবে বরিশালে শিল্পকলা একাডেমির আওতাধীন সাংস্কৃকিত সংগঠনগুলো। বর্তমানে চারুকলা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক ও তালযন্ত্র এই ৬ বিভাগে শিল্পকলার ৭০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে উপস্থিত আছে ২০০ জন। স্থান ও সুবিধার অভাবে তারা দীর্ঘ বছর ধরে বেশ কষ্ট করেই শিক্ষা গ্রহন করেছে। এছাড়া স্থানের অভাবে একাডেমি করতে পারেনি অনেক গুরুত্বপূর্ন অনুষ্ঠান। হাসানুর রশিদ মাকসুদ বলেন, অশ্বিনী কুমার হল ভাড়া নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করা বেশ খরচ সাপেক্ষ। নিজেদের স্থানের অভাবে বিভিন্ন স্থান ভাড়া নিয়ে এতদিন নানা কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে। বরাদ্ধের সীমাবদ্ধতার কারনে বেশ কিছু অনুষ্ঠান স্থান মিলিয়ে করতে পারেনি তারা। তবে এখন পারবে, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শিল্পকলা একাডেমি ভবনে পুরো সুবিধা ভোগ করতে পারবে। বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমিতে মাত্র ৫ জন কর্মি রয়েছে। যে কারনে অনেক কাজ বাইরের লোক এনে করাতে হয়। ভবনে স্থানান্তরিত হলে বরাদ্ধ ও জনবল উভয়ের প্রয়োজন পড়বে। এজন্য ইতিমধ্যে বরাদ্ধ বাড়ানো ও ১৬ জন কর্মির জন্য আবেদন করা হয়েছে। সর্বোপরি চাওয়া পাওয়ার হিসেব ভুলে গিয়ে বরিশালের শিল্পকলা একাডেমির পথচলা শুরু হওয়ায় খুশি হাসানুর রশিদ মাকসুদ। কারন এটি শুরুর মাধ্যমে এ অঞ্চলের সাস্কৃতিক অঙ্গনে প্রানের সঞ্চার হবে বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারন সম্পাদক দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, এত বছর পরেও অসম্পূর্ন কাজ হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির। ঠিকাদাররা কাজ করেছে তাদের মতন, তবে তা সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য কতটা উপযোগি হয়েছে তা জানা নেই। একাডেমির অডিটরিয়ামের লাইটিং কোন ভাবেই নাটকের জন্য উপযোগি নয় বলেন তিনি। যেখানে নাট্য চর্চা শিল্পকলার একটি গুরুত্বপূর্ন বিভাগ। মুক্ত মঞ্চের আকার অনেকটাই ছোট করা হয়েছে। যেখানে খোলা মেলা অনুশীলন অসম্ভব। একাডেমির এই কাজকে পুরোই অরক্ষিত কাজ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সীমানা প্রাচীর ছোট আকারের হওয়ায় ও সিসি টিভি ক্যামেরার কোন ব্যবস্থা না থাকায় এখানের সুরক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই শুন্য। বরিশালের ৩৫ টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের দাবি এ সকল সীমাবদ্ধতা দুর করে দ্রুত কাঙ্খিত শিল্পকলা একাডেমিকে পরিপূর্নতা দান করা হোক। এ দাবি তারা সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ইতিমধ্যে তুলেছেন জানিয়ে দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, দাবী পূরনের খাতিরে প্রয়োজনে তারা যথাযত কর্মসূচী গ্রহন করবেন। ##