• ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্লাকমেইল ও প্রতিকার – ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন

report71
প্রকাশিত অক্টোবর ২, ২০২১, ১৪:৩৭ অপরাহ্ণ
ব্লাকমেইল ও প্রতিকার – ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন

কলেজ লাইফের প্রথম দিক থেকেই নীলা আর রবিন এর পরিচয়, তারপর প্রেম।এরপরে পরষ্পরের আরো কাছাকছি আসা। কিন্তু বছর না ঘুরতেই নীলা জানতে পারল রবিনের আরো একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে! নীলা সম্পর্ক শেষ করে দিলো যে যার মত ভালো থাকবে বলে, কিন্তু রবিন তা হতে দিলো না।
তার কাছে থাকা তাদের অন্তরঙ্গ ছবি এবং ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে ব্লাকমেইল করা শুরু করল!
যে ছিল হৃদয়ের দাবিদার আজ সে এক নির্মম বিভীষিকা। অপমানে লজ্জায় নীলার মনে হতে লাগল আত্মহননই বুঝি মুক্তির একমাত্র পথ।

ঠিক এমন হাজারো নীলার সাথে ঘটছে এরকম ঘটনা। ব্লাকমেইল এর শিকার হয়ে আত্মহত্যা যেন একটা নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনায় রুপ নিয়েছে আজকাল!
হয়রানির শিকার হলেও ভুক্তভোগীদের ৩০ শতাংশই এর বিরুদ্ধে কীভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় সে বিষয়ে জানেন না। বাকীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ মান সম্মান নষ্ট হবে কিংবা অভিযোগ করে লাভ হবেনা ভেবে সহ্য করেন।
অথচ একটু সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করলে গল্পটা অন্যরকম একটা পরিসমাপ্তি হতে পারে।

সোশাল মিডিয়ায় ব্লাকমেইল এর হুমকি আজকাল অহরহ ঘটছে। এই ধরনের অপরাধ সাইবার অপরাধ নামে পরিচিত। এবং বেশিরভাগ শিকার নারীরা।

পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ভার্চুয়াল জগতে যত অপরাধ হচ্ছে সেসবের বেশিরভাগ শিকার হচ্ছে নারীরা। যেসব নারী সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন তাদের মধ্যে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীর সংখ্যাই বেশি। সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের মধ্যে ৭৩ ভাগ সাইবার বুলিংয়ে আক্রান্ত। নারীরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ নানাভাবে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন।
এই সকল অপরাধের মাঝে ব্লাকমেইল অন্যতম।

ব্লাকমেইল কী সেটা আমরা সবাই জানি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আপনার ব্যক্তিগত এমন কোন তথ্য বা চিত্র যদি কারো কাছে থাকে যেটি প্রকাশ পেলে আপনার সামাজিক মান-মর্যাদার হানি হবে এবং সেটি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে কেউ যদি আপনাকে ইচ্ছার বিরূদ্ধে কোন কাজ করাতে চায়, তাকেই বলে ব্ল্যাকমেইল। 

এবার আসি মেইন কথায়। আপনি যদি এ ধরণের ব্ল্যাকমেইল-এর শিকার হন, তবে নিম্নের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করুনঃ

ক) শুরুতেই যে কথাটি মনে রাখবেন সেটি হচ্ছে- আপনি অপরাধী নন, ভিকটিম। এটা আপনার দোষ নয়, অপরাধীর দোষ। তাই মাথা উঁচু রাখুন। আপনার অতীতকে আপনি পেছনে ফেলে এসেছেন, সেটাকে খুঁচিয়ে বের করে কোন কাপুরুষ বর্বর যদি সুযোগ নিতে চায় তবে সেটা আপনার দোষ না।

খ) দেশের প্রচলিত আইন সম্পূর্ণরূপে আপনার পক্ষে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৮৩ ধারা অনুযায়ী, যে কোন ধরণের ব্ল্যাকমেইল-কে এক্সটরশন বা চাঁদাবাজির আওতায় ফেলা যাবে, ৩৮৪ ধারা অনুযায়ী এর শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড, সেটি জরিমানাসহ বা ব্যতীরেকে।

এবার আসি অনলাইন মিডিয়ায় কেউ ব্লাকমেইল করলে তার শাস্তিঃ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ধারা ২৫ এর উপধারা ১ এ বলা হয়েছে “যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক জানা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন সহজ কথায় ব্লাকমেইল করার উদ্দেশ্যে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন তাহলে তিনি ধারা ২৫(২) অনুযায়ী অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং অনধিক ৩ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে এবং এই অপরাধ পূণরায় করলে অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড অথবা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।

আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ধারা ২৯ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোন মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এবং যদি কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এগুলো সব ই জামিন অযোগ্য অপরাধ।
জ্বি, ঠিক পড়েছেন । সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ আপনার সাথে উপরিউক্ত কাজগুলো করলে সাহস করে মামলা করে দিন, প্রমাণ হলে বাছাধন কয়েকবছর “রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায়” ফ্রিতে থাকা খাওয়ার সুবিধা পাবে।

বিশেষ কিছু করনীয় এবং পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেনঃ

প্রথমেই আসি সাইবার স্পেসে ব্লাকমেইল সহ বিভিন্ন অপরাধের শিকার হওয়া নারীদের সহায়তা করার জন্য পুলিশের স্পেশাল একটা সাপোর্ট সেন্টার সম্পর্কে ঃ

‘Police Cyber Support for Women’ নামক ফেসবুক পেজের পাশাপাশি ই-মেইল নম্বর ও হটলাইন চালু করেছে পুলিশ সদর দফতর। যার মাধ্যমে সাইবার স্পেসে সংঘটিত নারীর প্রতি হয়রানিমূলক অপরাধসমূহের অভিযোগ গ্রহণ, প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও আইনি সহায়তা দেয়া হবে।
যেসব নারী সাইবার বুলিং, আইডি হ্যাক, স্পর্শকাতর তথ্য-ছবি-ভিডিও প্রকাশ, সাইবার স্পেসে যৌন হয়রানি ইত্যাদি অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তারা এখানে অভিযোগ জানাতে পারবেন। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে ভিকটিমের তথ্য গোপন রেখে প্রয়োজনীয় সেবা ও আইনি সহায়তা দেবে পুলিশ সদর দফতর।
এই ইউনিটের বিশেষত্ব হল, এখানে যারা সেবা দেবেন, তদন্ত করবেন, তারা সবাই পুলিশের নারী সদস্য। যেখানে ভিকটিমরা নির্দ্বিধায় তাদের সমস্যাগুলো বলতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে ভিকটিমের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করেই তাকে সেবা দেয়া হবে।
কোনো ভিকটিম চাইলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে
সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।

ভিকটিমরা যেভাবে যোগাযোগ করবেন : ফেসবুক পেজ- Police Cyber Support for Women PCSW, ই-মেইল: cybersupport.women¦police.gov.bd হটলাইন মোবাইল নম্বর: ০১৩২০০০০৮৮৮

*****বিশেষ কিছু করনীয়ঃ

প্রথমেই বলব, যখন বুঝতে পারবেন আপনি ব্ল্যাকমেইল-এর শিকার হচ্ছেন, ভয় না পেয়ে কাছের মানুষদের সহায়তা নিন। প্রয়োজনে পরিবারকে জানান। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারকে জানাতে দ্বিধা করেন। জেনে রাখুন, আপনার চরম দুঃসময়ে আপনার পরিবারই আপনার সবচাইতে বড় ভরসা। তারা হয়তো আপনার অতীতের ভুলের কারণে কষ্ট পাবেন, কিন্তু প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গেলে আপনার সাহায্যে অবশ্যই তারা এগিয়ে আসবেন।

প্রথম দিকে যা বলেছি সেটা আবারো বলি, মনের জোর হারাবেন না বা নিজেকে দোষ দেবেন না। ব্ল্যাকমেইলিং একটি জঘন্য অপরাধ, আমাদের তথাকথিত সমাজ আপনাকে যতই ছোট করতে চাক না কেন আইন অনুযায়ী আপনি সহায়তা পাবেন। সমাজের তথাকথিত সুশীলদের চোখ-কপালে তোলাকে অগ্রাহ্য করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন, আইনের সহায়তা নিন। জয় আপনার ই হবে।

ধন্যবাদ।
এম.এম. সাহিদ ইসলাম,
সাধারণ সম্পাদক, জাস্টিস সার্ভড ফাউন্ডেশন।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।