২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

শিরোনাম
তেলবাহী লড়ি উল্টে গিয়ে আগুন লেগে এক জনের মৃত্যু। ভূমি বিষয়ক তথ্যাদি স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করো হয়েছে-ভূমিমন্ত্রী মির্জা ফকরুলরা তারেক জিয়ার নির্দেশে জনগনের সাথে প্রতারনা ও তামশা করছে-আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিগ বার্ড ইন কেইজ: ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার  ঢাবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ১ কোটি টাকার বৃত্তি ফান্ড গঠিত হাইকোর্টের রায়ে ডিন পদে নিয়োগ পেলেন যবিপ্রবির ড. শিরিন জয় সেট সেন্টার’ থেকে মিলবে প্রশিক্ষণ, বাড়বে কর্মসংস্থান: পীরগঞ্জে স্পীকার বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস আগামীকাল টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদি মোহম্মদ আর নেই

মনে নেই যুদ্ধের স্মৃতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মজিদ মিয়ার

আপডেট: ডিসেম্বর ৬, ২০২১

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন

বামনা(বরগুনা) প্রতিনিধিঃ
প্রায় ৬ ফুট লম্বা বিশালাকৃতির দেহ আজ নতজানু। বয়স আর রোগ এই দুইয়ে মিলে জীবন এখন শেষ সূর্যাস্তের অপেক্ষায়। তবু মনে আঁর এখনও রয়েছে প্রবল তেজ। যুদ্ধকালীন সময়ের বীর সেনাপতি এখন তাঁর বীরত্বের সেই স্মৃতিগুলো মনে করতে পারছেন না কিছুই। শুধু বর্তমান নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। তিনি হলেন ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুকাবুনিয়ার যুদ্ধকালীন কমান্ডার অশীতিপর বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. মজিদ মিয়া। তাঁর জাতীয় পরিচয় পত্র অনুযায়ী বর্তমান বয়স ৮২ বছর। তাঁর জন্ম ৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৯ সাল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ভুক্তির গেজেট নম্বর ৫৩৩,লাল মুক্তি বার্তা নম্বর ০৬০৬০৪০০২২।
তিনি শুধু যুদ্ধকালীন কমান্ডারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ স্কুল শিক্ষক একজন ভালো ফুটবলার। যার সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অনেক ছাত্র এখন দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষ হয়েছেন। সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর দুই ছেলেদেরকেও। বড় ছেলে আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে কানাডা প্রবাসী আর ছোট ছেলে আবদুস ছালাম স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের উপ-সচিব পদে চাকুরীরত। স্বাধীনতার পর থেকে টানা প্রায় ২০ বছর তিনি বামনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দ্বায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সংবাদ সংগ্রহ করতে সরেজমিনে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. মজিদ মিয়ার বাড়ী বরগুনার বামনা উপজেলার বুকাবুনিয়া ইউনিয়নের শিংড়াবুনিয়া গ্রামে তাঁর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ীর সামনে আলিশায় বসে মুড়ি খাচ্ছেন তিনি। ঘরের সামনে যাওয়ার সাথে সাথেই অপরিচিত আমাদের বসতে বলেন। কিছু সময় বসে থেকে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম মুক্তিযুদ্ধের কথা তাঁর যুদ্ধকালীর স্মৃতির কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের কোন স্মৃতিই তিনি এখন মনে করতে পারছেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তবে বাড়ীতে কোন অতিথি আসলে তাকে আপ্যায়নে ত্রুতি নেই তাঁর। বার বার তাঁর স্ত্রীকে ডেকে ডেকে অস্থির করে ফেলেন তিনি। অতিথিকে নাস্তা দেও, চা দেও এমন কথা বলতেই থাকেন অবিরত। আর স্ত্রীরও কোন বিরক্ত নেই তাঁর এমন আচারনে। কিন্তু ৫০ বছর আগের সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কোন স্মৃতি মনে পরে কিনা জানতে চাইলে শুধুই বলেন আমার কিছু মনে নেই। সবসময়ই তাঁর মুখে শুধু মহান আল্লাহর নাম।
তবে এখনো কিছুটা সবল আছেন তাঁর স্ত্রী হাসিনা বেগম। যিনি তাঁর কাছে দেখে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে মজিদ স্যারের সেই বীরত্বের স্মৃতির দিনগুলো।
তিনি জানান তাঁর জানায় কিছু স্মৃতিকথা। ‘ ১৯৬০ সালের দিকে বিএম কলেজে পড়া অবস্থায় বাড়িতে কাউকে কিছু না বলে আ. মজিদ মিয়া পাকিস্তান সেনাবাহীনির কমান্ডার পদে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের লাহরে পোস্টিং হন। ১৯৬৪ সালের দিকে নতুন বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে পাকিস্তানের লাহোরে চলে যান চাকুরীতে। পরে ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারতযুদ্ধ হলে সেই যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের এক অংশের নেতৃত্ব দেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বাঙালী সৈন্যদের ওই যুদ্ধে সম্মুখভাবে অবস্থান করতে নির্দেশ দেন। যাতে মারা গেলে বাঙালীরা আগে মরে। এছাড়াও বাঙ্গালী সৈন্যদের খাওয়া দাওয়াও পাকিস্তানী সরকার কম দিতেন। বাঙ্গালীদের প্রতি এমন বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানীদের প্রতি তাঁর ক্ষোভসৃষ্টি হয়। সে ওই চাকরী ছেড়ে চলে আসার অজুহাত খুজতে থাকেন। এমন সময় তাঁর বড় ভাই আকাব আলী সিকদার মারা গেলে তিনি বাংলাদেশে গ্রামের বাড়ীতে চলে আসেন। তার পর থেকে তিনি আর ওই সেনাবাহীনীর চাকুরীতে যোগদান করতে পাকিস্তানে যায়নি। পরে ১৯৬৯ সালে বুকাবুনিয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাজী আলী আকব্বর এর অনুপ্রেরণায় ওই বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। খেলাধুলা আর শারীরিক কসরত প্রশিক্ষন দিতেন শিক্ষার্থীদের। ১৯৭১ সালের ৭মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভাষনের পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। যেহেতু তিনি একসময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন সেহেতু যুদ্ধের সকল কৌশল তাঁর জানাছিলো। তিনি প্রতিদিন স্কুলের শিক্ষার্থীদের শারীরিক কষরতের পাশাপাশি কিছু বাঁশ ও লাঠি দিয়ে যুদ্ধের কৌশল শেখাতে থাকেন। এমন সময় বুকাবুনিয়ার পাশে মঠবাড়িয়া উপজেলার রাজারহাট নামকস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট ঘাটি স্থাপন করেন তৎকালীন নবম সেক্টরের ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম ও উপ-অধিনায়ক আলমগীর হোসেন। তাদের সাথে মজিদ মিয়ার যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। সকল মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার হবে বুকাবুনিয়ায়। কারণ বুকাবুনিয়ার অবস্থান সকল এলাকা থেকে মাঝখানে হওয়ায় এখানে ক্যাম্প স্থাপন করলে মুক্তি যোদ্ধার একদিকে নিরাপদ থাকবে অন্য দিকে সব স্থানে মুক্তিযোদ্ধার যাতায়াত করতে সুবিধা হবে। আর এই হেড কোয়ার্টাদের কমান্ডারের দ্বায়িত্ব পান আ. মজিদ মিয়া। এ পর থেকে প্রতিদিন গভীর রাতে এখানে আগত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষন দিতেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর কাছেই এই দক্ষিনাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম প্রশিক্ষন পেয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন।
৯নম্নর সেক্টরের সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুকাবুনিয়ার যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. মজিদ মিয়ার সেই বীরত্বের কথাগুলো তাঁর অসুস্থ্যতার পূর্বে কোন পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে ছাপানো কিংবা এই বীরের কর্মময় জীবনী কোথাও প্রকাশ না হওয়ায় চাপা ক্ষোভ তাঁর স্ত্রী হাসিনা বেগমের। তবুও তিনি খুশি অন্ততো স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে তাঁর এই বীর স্বামীকে নিয়ে কিছু জীবনী প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি বলেন, আমি তাঁর সহধর্মীনী হিসাবে তাঁর সাথে সর্বক্ষনিক থেকে যতটুকু মনে আছে ততটুকু বলেছি। আমার স্বামীর এখন ডিমেনসিয়া(স্মৃতিভ্রষ্ট), বার্ধাক্য, আর হৃদ রোগে আক্রান্ত । পুরানো দিনের কোন কথাই তাঁর আর মনে নেই। এমনকি এখন কিছু বললে কিছুসময় পরে তাঁর আর মনে থাকে না। তবুও মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি এখনো আমাদের মাঝে আছেন।
অশীতিপর বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. মজিদ মিয়ার ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা ও বামনা থানামুক্ত করার বীর সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন খান সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমি মজিদ মিয়ার কাছ থেকে প্রশিক্ষন নিয়েছি। আমি দেখেছি দেশের প্রতি তাঁর মমত্বের গভীরতা। ২৪ নভেম্বর ভোর রাতে তিনি আমাদের সাথে বামনা থানা আক্রমনে অংশ নিয়েছিলেন। মজিদ মিয়া ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম সরদারের নির্দেশনায় আমরা থানা ভবনের ভিতর আক্রমন চালাই, বামনা থানা মুক্ত করি। মহান মুক্তিযুদ্ধে আ. মজিদ মিয়ার অবদান অবিস্মরণীয়।
তৎকালীন বরগুনা মহাকুমার মুজিব বাহিনীর প্রধান ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান বলেন, আ. মজিদ মিয়া সাবসেক্টর হেড কোয়ার্টারের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ শিক্ষাগুরু। তাঁর কাছে পাওয়া প্রাথমিক শিক্ষা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করার উৎসাহ পেয়েছিলো। তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ্য। আমরা তাঁর দ্বীর্ঘায়ু ও সুস্হতা কামনা করছি।

  • ফেইসবুক শেয়ার করুন
     
Website Design and Developed By Engineer BD Network