• ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তামাক নিয়ে খেলছে আশামনি!

report71
প্রকাশিত এপ্রিল ৯, ২০২২, ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ
তামাক নিয়ে খেলছে আশামনি!

সাঈদ পান্থ
মরন বিষ তামাক নিয়ে মেঝেতে (ফ্লোরে) খেলছে আশামনি নামে সাড়ে ৩ বছরের এক শিশু। কখনো খেলছে, আবার কখনো খেলার ছলে মুখে দিচ্ছে। আশামনির জানা নেই এটি কি বা এ দিয়ে কি করা হয়। তাই তার মনের খুসিতে এই মরন বিষ নিয়ে খেলছিল। তবে তার বাবা ও মা তার কাছাকাছি থাকলেও তারা পেটের দায়ে সেই তামাক নিয়েই কাছে ব্যস্ত। সংসারের ঘানি টানতে তাদের পরিবারের এই করুন দশা। তবে সেখানে শুধু আশামনিই নয় আশামনির মত ৭/৮ জন শিশু এই বিষ নিয়ে খেলছে। উপরের এই চিত্রটি বরিশাল নগরীর কাউনিয়া সাধুর বটতলা নামক কারিকর বিড়ির কারখানা শাখায় দেখা যায়।

আশামনির বাবা ছদ্বনাম হারুন হাওলাদার মা রাহেলা বেগম ওই বিড়ি কারখানার নিয়মিত শ্রমিক। দুই জনই কাজ না করলে এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে তাদের সংসার চলে না। কারণ আশামনি ছাড়াও তাদের সংসারে আরো ১ বছরের এক পুত্র শিশু রয়েছে। সেই পুত্রও কারখানার মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে। তাদের বাসায়ও কেউ নেই। তাই তারা বাধ্য হয়েই বিড়ির কারখানার তামাকের মধ্যে তাদের শিশুদের নিয়ে এসেছে।

তবে আশামনির বাবা হারুন হাওলাদার জানান, সপ্তাহে মাত্র তিন দিন কারখানা খোলা। তাই যে দিন যে দিন কারখানা খোলা সেই দিন পরিবারের সবাই এখানে কাজে আসি। ৩ দিনের আয় দিয়েই সপ্তাহের বাকি দিনগুলো চলতে হয় আমাদের।

তিনি বলেন, আশামনিকে ঘরেতে রেখে আশার মত আমার অন্যকোন লোক নেই। আর কখন আশামনি খেলার ছলে তামাক মুখে দিয়ে তাও তিনি দেখেননি। তিনি জানান, আশামনি জন্ম থেকেই রোগ লেগেই আছে। তবে আমার মনে হয় তামাকের কারণে আমার কলিজার টুকরার এই রোগ হতে পারে। কাষিতো আশামনির লেগেই আছে। কয়েকবার ডাক্তার দেখানো হয়েছে আশামনিকে, কিন্তু কাশি কমেনি।

ওই কারখানাই ঠোলে তামাক ভরছিল শিশু শ্রমিক ছদ্বনাম আরিফুর রহমান (১২)। আরিফ জানায়, স্কুলের চাইতে বিড়ির কারখানায় মোর বেশী ভালো লাগে। এইহানে কাম করলে টাহা পাওয়া যায়। কিন্তু স্কুলে গেলে উল্ডা মাস্টারের মাইর খাইতে হয়। তাই মুই এইহানেই আই। আরিফ জানান, বিড়ির তামাকের গোন্ধে আগে মোর নাক, চোক্ষে জ্বালা পোড়া হরতো। এহন আর জ্বালাপোড়া হরে না। সহ্য হয়ে গেছে মোর।

আরিফ আর আশামনির মতো আরো অনেক শিশু ওই কারখানায় ছিল। এসকল শিশুদের বাবা-মাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও বিড়ি কারখানার নিয়মিত শ্রমিক। কারো ঘরেতে অন্যকোন কোন সদস্য নেই। আবার কেউ সখ করে শিশুটিকে নিয়ে এসেছে এই কারখানায়। আবার কেউ নিজেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। সেখানকার একাধিক ব্যাক্তির সাথে কথা বললে তারা জানায়, বিড়ি কারখানায় কাজ করলে ক্ষতি হবে এটা জানি, কিন্তু কি কি ক্ষতি হবে তা জানিনা। আর তামাক তো শিশু গ্রহন করছেনা তবে কিভাবে ক্ষতি হয় তাই জানেন না তারা। তবে তারা খুশি কোন রোগ হলে কারখানার মালিক ৫’শ করে টাকা দেয় এই কথা ভেবে।

কারিকর বিড়ির সাধুর বটতলা কারখানার ম্যানেজার বলেন, আমরা শিশুদের কাজে নেই না। তাই কারখানার মধ্যে কয়েক স্থানে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছি। সাইনবোর্ডে বলা হয়েছে, কোন শ্রমিকের সাথে কোন শিশু কারখানায় আসলে তার নাম্বার বাতিল করা হবে।

তারপরও বাবা মা আসলে তার শিশুকে কোথায় রেখে আসবে, তাই কিছু বলিনা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়ম অনুসারে শিশুদের জন্য একটি আলাদা স্থান দরকার। সেখানে এ সব শিশুদের দেখা শোনার জন্য লোক দরকার। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারছি না।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়, বরিশাল সিভিল সার্জন কার্যালয় ও বক্ষ্যবাধী হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগ বা বরিশাল জেলার তামাক ও ধূমপান জনিত কারনে আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে তারা জানিয়েছেন, এ্যাজমা, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস ও পাকস্থলী জনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা তামাক ও ধূমপানের ফলে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। তবে আশংকাজনিত হারে এসব রোগে তরুন ও যুবকরা জড়িয়ে পড়ছে।

বরিশালে অবস্থিত বিড়ি কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বরিশালের কারিকর বিড়ি কারখানায় ৬টি শাখা রয়েছে। কারিকর বিড়ির বিভিন্ন শাখা গুলো হচ্ছে নগরীর পলাশপুর, লাকুটিয়া সড়ক, বিসিক, পুরানপাড়া, পশ্চিম কাউনিয়া, কাশিপুর এলাকায় রয়েছে। এ ছাড়া বাজার রোড এলাকায় অবস্থিত সুলতানী বিড়ি।

যেখানে কর্মরত রয়েছে সহস্রাধিক শিশু। ৫-১৫ বছরের এসকল শিশুরা মায়ের কোলে থাকাকালীন সময় থেকেই কারখানার অভ্যন্তরে অবস্থান করে। সবকিছু ভাল করে বুঝতে শেখার আগেই শিশুদের কোমল হাতে খেলনার পরিবর্তে তামাকের গুরা আর বিড়ির খোসা উঠে আসে।

দৈনিক ১২/১৪ ঘন্টার শ্রমে সাপ্তাহিত ৩ কর্মদিবসে মজুরী হিসেবে এসকল শিশুদের দেয়া হয় মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। বাড়তি টাকা আয়ের চাহিদায় প্রাইমারি শিক্ষার গন্ডী অতিক্রম করতেই ঝড়ে পরে অধিকাংশ শিশু। ছোটবেলা থেকেই পরিপূর্ন শারীরিক বিকাশ না হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগকে সঙ্গী করে বিড়ি কারখানায়ই বড় হতে থাকে এসকল শিশুরা। কারখানায় কর্মরত অসংখ্য শিশুর শুকিয়ে যাওয়া মুখমন্ডল। অনবরত হাচি আর কাঁশি বলে দেয় এ সকল শিশুরা তামাকের বিষে অক্রান্ত।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মজিবর রহমান বলেন, ক্যান্সার হওয়ার মত ৬৯টি বিষাক্ত পদার্থ তামাকে বিদ্যমান থাকে। ফলে তামাকের মধ্যে অবস্থান করা একটি শিশু ও ব্যক্তি শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে তা গ্রহন করেন। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধোয়াবিহীন তামাক ব্যাবহারকারী দরিদ্র নারী পুরষরা ইতিপূর্বে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার নিয়ে মৃত্যুবরন করলেও চিকিৎসা করানোর সুযোগ না থাকায় অনেকে জানতেই পারেনা তার কি রোগ হয়েছিল।

তিনি বলেন, সুস্থ্যভাবে বাঁচতে হলে সকলকে তামাক থেকে বেড়িয়ে আসা দরকার। শিশু বয়সে তামাক কারখানায় কাজ করলে তামাক সেবন না করলেও সে শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সেবন ও আসক্ত হয়ে পরবে এবং তামাক ব্যবহারের মতই ক্ষতি হবে। নিয়মিত বিভিন্ন রোগ ব্যাধির পাশাপাশি অল্প বয়সে কর্মক্ষমতা হারানো, নিউমোনিয়া ,পঙ্গুত্ব বরন ও তীব্র ক্যান্সার ঝুঁকি রয়েছে।

বিড়ির কাজে কর্মরত একাধিক শ্রমিক বলেন, বস্তা ভর্তি তামাক বের করতে হয়। সেখানে থাকা তামাকের বড় অংশগুলো পুনরায় গুড়া করতে হয়। পরে বিড়ির ঠোলে বা খোসায় তামাক ভরতে হয়। এই কাজগুলো কয়েকমাস করলেই শ্রমিকদের কাশি হয়ে যায়। বেশী দিন করলে আর শরীরে শক্তি থাকে না। তামাকের ঝাজালো দূর্গন্ধের কারনে শ্রমিকরাই কাজ করতে রাজি হতোনা। এরপর বেশী বেতন ও সন্তানদের ভালো চাকুরীর প্রলোভনে এ কাজ করাতে উৎসাহ দেন শ্রমিক নেতারা। কিন্তু শ্রমিকরা একসাথে কিছুদিন কাজ করলেই অসুস্থ্য হয়ে পরেন।

বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, কোন শিশু তামাকের মধ্যে থাকে হবে তার অনেক ধরনের ক্ষতি হতে পারে। শুধু শিশুই নয় যে কোন ব্যক্তি শ্বাসকষ্ট, এ্যাজমা, হৃদরোগ, ফুসফুস ও পাকস্থলী জনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর এ সব রোগে রোগীর সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধূমপান ও তামাক ব্যাবহারকারীরা এসব রোগে বেশী আক্রন্ত হচ্ছে।

তামাকের বিরুদ্ধে কর্মকান্ড করা তরুণ ভিত্তিক সংগঠন দি অডেশাস্ এর সাধারণ সম্পাদক কিশোর রায় আকাশ বলেন, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মাদক ঘিরে ধরেছে আমাদের যুব সমাজকে। আমরা মনে করি তামাক বা সিগারেটই মাদক গ্রহনের ১ম স্তর। প্রথমে বন্ধুদের সাথে একটা দুইটি সিগারেট। পরে তাদেরই পাল্লায় পরে মাদকের অন্য অন্য শাখায় প্রবেশ করে। অলিতে গলিতে সিগারেট ও তামাকের দোকান। এমনকি প্রায় প্রতিটি স্কুল কলেজের সামনেও চলছে এর ক্রয় বিক্রয়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমাদের এই সংগঠন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা স্কুলের আশপাশের দোকানে সিগারেটসহ তামাক ও তামাকজাত পণ্য বিক্রি বন্ধের জন্য প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছি।

তামাক ও ধূমপান বিরোধী উন্নয়ন সংগঠন স্কোপ নির্বাহী পরিচালক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, আইনে বলা আছে ১৮ বছরের নিচে কোন ব্যক্তির কাছে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করা যাবে না, অথবা ওই ব্যক্তিকে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিপণন বা বিতরন কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। এ বিধান লংঘন করলে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্তনীয় হবে। কিন্তু এখানে নেই কোন আইনের বালাই।

তামাক ও মাদক বিরোধী সংগঠন আবিস্কার এর চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দিক সোহেল বলেন, একদিকে তামাকপন্যের প্রচার অপরদিকে তামাক নিরুৎসাহিত করতে সরকারি কর্মকান্ড না থাকায় তামাকের ব্যাপকতা কয়েকগুন বেশী ত্বরান্বিত হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৩% নাগরিক যুবক, তাদের অনেকেই তামাক ও ধূমপানের আগ্রাসনের স্বীকার হচ্ছে। প্রচার প্রচারনার মাধ্যমে তামাক ও ধূমপানের কুফল সকলের নিকট তুলে ধরা হলে সচেতনতা বৃদ্ধি পেত।

পাশাপাশি শ্রমনির্ভর তামাক কারখানাগুলোকে যান্ত্রিকতার আওতায় আনার দাবী জানিয়ে তিনি বলেন, শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে কর্মক্ষম হয়ে পরলে দেশের এসডিজি বাস্তবায়নে তা অন্তরায় হয়ে দারাবে।

এদিকে বরিশাল নগরীতে নানা কৌশলে সিগারেটের পাশাপাশি ধোয়াবিহীন তামাকপন্যের প্রচারনা চলছে। বিড়ির মোড়কে স্বাস্থ্য সতর্কবানীর যে চিত্র দেয়া হয়েছে তা চোখে পরার মত না। এছাড়া কৌটায় বাজারজাত করা অনেক জর্দা, পলিথিনে মোড়ানো সাদা পাতায় কোন সতর্কবানী নেই। সিগারেটে বিক্রর বক্সে এ সকল পন্য প্রদর্শন করে বিক্রয় ও প্রচারনা চলছে নগরীতে।

নগরীর প্রায় প্রতিটি চা-সিগারেটের দোকানে সাটানো হয়েছে কৌশলী বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপনের বিষয়ে মাঝে মধ্যে প্রশাসন অভিযান চালালেও তাতে তেমন সুফল আসছে না। কারণ কোন দোকানীকে ভ্রাম্যমান আদালত জরিমানা করলে সেই টাকা দোকানীকে পরিশোধ করে তামাক ও সিগারেট কোম্পানীগুলো।

এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রনের জন্য আগামী আইন শৃংখলা কমিটির সভায় সিদান্ত নেয়া হবে। তামাক বা সিগারেটের বিজ্ঞাপন, অবাধে বিক্রি ও শিশু শ্রম নিয়ে কাজ করা হবে। মোবাইল কোটের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়া বিড়ি কারখানাগুলো পরিদর্শন করে দেখবো। যেখানে নারী শ্রমিকরা কাজ করবে সেখানে ডে-কেয়ার সেন্টার রাখার বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের সাথে মিটিং করে সিদান্ত নেয়া হবে বলে জানা জেলা প্রশাসক।