আপডেট: এপ্রিল ১০, ২০২২
জ্ঞানী ব্যক্তির পরিচয় কি? অনেক কিছু জানলেই কি সে জ্ঞানী? বিষয়টি আদৌ তেমন নয়। বরং অতীতে এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পারি যেখানে ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা ও বই-পুস্তকের জ্ঞান অনেক কম হলেও ইতিহাস তাদের প্রখ্যাত জ্ঞানী হিসেবে স্মরণ করে।
সারাদিন বই-পুস্তকের মাঝে ডুবে থাকলে কেবল বইপ্রেমিই হওয়া যায়, জ্ঞানী নয়। জ্ঞানী হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো “উপলব্ধি”। উপলব্ধি মানে বোধশক্তি দ্বারা সঠিক ভাব লব্ধ করার সক্ষমতা। উপলব্ধির ভিত্তিতে জ্ঞানের সার্থকতা নির্ণয় হয়। যার উপলব্ধি যত বেশি তার জ্ঞানার্জন তাকে তত বেশি সফল করে তোলে। উপলব্ধিহীন অনেক তথ্যধারণকারী ব্যক্তি মলাট বদ্ধ নির্জীব বইয়ের বিদ্যার মতো। অবশ্য এখন তো আর বইয়ের বিদ্যা/তথ্য ঠোটস্থ করার প্রয়োজনও পড়েনা গুগলের কল্যাণে। অর্থাৎ জ্ঞান ও উপলব্ধি যখন এ দুটোর সম্মিলন ঘটে ঠিক তখনই প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি তৈরি হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একই শ্রেণীকক্ষে দুজন শিক্ষার্থীর ভিন্ন সময়ে যেকোনো পড়া আয়ত্ত করার ক্ষমতা। একজনের হয়ত পড়াটি আয়ত্ত করতে বেশি সময় লাগলেও অপরজনের তার চেয়েও কম সময় লাগছে। ঠিক তেমনি আমাদের জীবনেও এমন অনেক বিষয় আছে যা সমাজের সকল স্তরের সকল ধরনের মানুষ একই সময়ে একই উপলব্ধি করতে পারেনা। যারা জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সঠিক সময়ে সঠিক উপলব্ধি করতে সক্ষম তারাই মূলত সমাজে বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে।
স্বকীয়তা হল ঠিক তেমনি একজন ব্যক্তির নিজস্বতা যা সাধারণত অন্য কারো মাঝে দেখা যায়না। আল্লাহ তা’আলা সকল জীবকে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বায়োলজিক্যালি আমাদের ডিএনএ কেও কিন্তু আমাদের স্বকীয়তাই বলা যেতে পারে। তবে আমরা যে স্বকীয়তার কথা বলছি তা দৈহিক নয় বরং আত্নিক। স্বকীয়তাই নিজেকে চিনতে শেখায় যা আত্মিক উন্নয়নের প্রথম সোপান।
উপলব্ধি আর স্বকীয়তা একে অন্যের পরিপূরক। মূলত উপলব্ধি থেকেই স্বকীয়তার আবির্ভাব। আমরা যখন কোন জ্ঞান অর্জন করি তখন সেটা থেকে একেকজনের একেকরকম উপলব্ধি হয় এবং সেই উপলব্ধি দিয়েই আমরা নিজেকে অন্যের থেকে আলাদা করতে পারি। আমাদের মাঝে তৈরি হয় স্বকীয়তা, সৃজনশীলতা। কিন্তু জ্ঞান অর্জন করার পর যদি আমরা যথার্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম না হই তাহলে আমাদের ভেতরের সেই স্বকীয়তার বিনাশ ঘটে। তখন নিষ্প্রাণ বইগুলোর সাথে আমাদের কোনো ফারাক থাকেনা যার লিপিবিদ্ধ আক্ষরিক জ্ঞান প্রায়োগিক জীবনে ফলপ্রসূ হয়না। তাই কোনো ব্যক্তিকে অন্ধ অনুকরণ করা হতে বিরত থাকতে হবে অথবা এমন কাউকে সত্যের স্থায়ী মাপকাঠি ধরে নেওয়া যাবেনা যার ভিত্তিকাঠামোই যথেষ্ট সন্দেহপূর্ণ।
মানুষ স্বভাবতই সৌন্দর্যনুসন্ধানী। সুন্দর খোঁজার এই প্রচেষ্টা ততদিন অব্যহত থাকে যতদিন না সে সন্তুষ্ট হয়। মানুষের মনের চাহিদা গড়ে উঠে সুন্দরের ভিত্তিতে। সুন্দর জিনিসের প্রতি মানুষের চাহিদা আজন্ম বেশি। সর্বোচ্চ সুন্দরটুকুকে উপলব্ধি না করে সে ক্ষান্ত হয়না। তখনই তার মধ্যে পরিপূর্ণতা আসতে শুরু করে, সে সঠিক উপলব্ধি করতে শেখে।
প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি হল তারাই যারা এই শাশ্বত সৌন্দর্যকে প্রথম যাত্রায় উপলব্ধি করে ধারণ করতে পারে এবং অযথা অসৌন্দর্যের স্বরূপ সন্ধানে সময় ব্যয় না করে সৃষ্টির মহাসত্য মহা সুন্দরকে পাওয়ার জন্য প্রবল মনোনিবেশ করে।
জ্ঞানী ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ পায় তার জ্ঞান দ্বারা অর্জিত উপলব্ধির বাস্তবতার প্রয়োগে। চিরন্তন এই চরম নান্দনিকতাকে উপলব্ধি করতে পেরে তাঁর নিকটতম সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ব্যক্তি তার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং এই প্রচেষ্টাই তার স্বকীয়তাকে শক্ত করে তুলে। শুরু হয় শাশ্বত পথে অন্তবিহীন চলা।
লেখকঃ শেখ মাহমুদ হাসান,শিক্ষার্থী,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।