প্রমত্তা পদ্মা পার হলেই দেখা মেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি। একতারার টুংটুং আওয়াজে উপস্থিতির জানান দেন ‘ধন্য ধন্য বলি তারে…শূন্যের ওপর পোস্তা করে’-এর ফকির লালন সাঁই। বিষাদসিন্ধুর মীর মশাররফ হোসেনের জন্মভিটা, বিপ্লবী বাঘা যতীনের স্মৃতি কিংবা কবি জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি হয়ে পৌঁছানো যায় সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায়। এসবকিছুই প্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে পদ্মার দক্ষিণ পারে, যা এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানী তথা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে যাকে আলাদা করে রেখেছিল স্রোতঃস্বিনী পদ্মা। এই নদীর কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা এসব সৌন্দর্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি বহু মানুষের। মাস-তিনেক হলো ঘুচেছে সেই দুঃখ। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। এখন মাত্র ৬ মিনিটে পদ্মা পার হয়ে আগের তুলনায় ২ থেকে ৫ ঘণ্টা কম সময়ে পৌঁছানো যাচ্ছে দক্ষিণের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের কাছে।
যে কারণে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক বিকাশ শুরু হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ভিড় বাড়তে শুরু করেছে এখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোয়।
নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মী শুভংকর চক্রবর্তী বলেন, ঢাকা থেকে বরিশালের দূরত্ব মাত্র ১৫৬ কিলোমিটার। এত কম দূরত্বে থেকেও সড়কপথে রাজধানীতে পৌঁছাতে লেগে যেত পুরো একটা দিন। প্রমত্তা পদ্মা আমাদের রাজধানী থেকে দূরে রেখেছিল। সেই দূরত্ব এখন আর নেই।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি, খুলনা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ঢাকা থেকে দূরত্ব মাত্র ১৭০ কিলোমিটার হলেও মোংলা বন্দর সেভাবে দাঁড়ায়নি কেবল পদ্মার কারণে। মোংলা বন্দরের সামনে থাকা পশুর নদীর অপর পাড়েই সুন্দরবন। প্রতিবছর দেশি-বিদেশি হাজার হাজার মানুষ আসে এই বনের সৌন্দর্য দেখতে। পদ্মা পাড়ির ঝামেলার কারণে আসা-যাওয়ায় অতিরিক্ত দুটি দিন চলে যেত। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে আসা যাচ্ছে মোংলা। যোগাযোগের এই সহজ সুবিধার কারণে আগের তুলনায় বাড়তে শুরু করেছে সুন্দরবন দেখতে আসা পর্যটকের সংখ্যা। কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে মোংলা বন্দরের।
ঐতিহ্য ও পর্যটন প্রশ্নে খুলনা বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা বাগেরহাট। এখানে একদিকে যেমন রয়েছে সুফি সাধক খানজাহান আলীর মাজার, তেমনই রয়েছে ষাট গম্ভুজ মসজিদ। মোংলা বন্দরের অবস্থানও এই জেলায়। পদ্মা সেতু চালুর পর পর্যটনশিল্পের প্রসার প্রশ্নে এই জেলা এরই মধ্যে চলে এসেছে সামনের সারিতে। সেখানকার সংসদ-সদস্য শেখ হেলালুদ্দিন বলেন, এখন সেতু পাড়ি দিয়ে প্রচুর মানুষ আসতে শুরু করেছে খানজাহান আলীর মাজার, ষাট গম্ভুজ মসজিদ আর সুন্দরবন দেখতে। পর্যটকদের আগমন মানে অর্থনৈতিকভাবে এই জেলার সমৃদ্ধি।
প্রায় একই কথা বলেন কুষ্টিয়া ৪ আসনের সংসদ-সদস্য আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ। যার নির্বাচনি এলাকা ধন্য হয়েছে বিপ্লবী বাঘা যতীন আর সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটায়। যেখানে এসে নিজের ছাউনি গেড়েছিলেন ফকির লালন সাঁই। সংসদ-সদস্য জর্জের এলাকায়ই রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি। কলকাতা থেকে খাজনা আদায়ের জন্য এ কুঠিবাড়িতে এসে অবস্থান করতেন রবীন্দ্রনাথ। সংসদ-সদস্য জর্জ বলেন, পদ্মার প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও মানুষ বহু আগে থেকেই আসেন এসব স্থান দেখতে। খুঁজে বেড়ান আমাদের সংগ্রাম, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের নানা দিক। পদ্মার ওপর সেতু হয়েছে। অনেক কম সময়ে পৌঁছানো যাচ্ছে কুষ্টিয়ায়। স্বাভাবিকভাবেই বাড়তে শুরু করেছে দর্শনার্থীদের ভিড়। ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে এখানকার পর্যটনশিল্প। সেই সঙ্গে সমৃদ্ধ হচ্ছি আমরা।
বাগেরহাট-কুষ্টিয়ার এসব স্থান ছাড়াও কালিয়ায় উদয় শংকরের বাড়ি, নড়াইলে এসএম সুলতানের জন্মভূমি, রাজবাড়ির জমিদার ভবন, ফরিদপুরের ওড়াকান্দির মাঠ, যশোরের সাগরদাঁড়িতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাস্তুভিটা ঘিরে থাকা পর্যটনকেন্দ্রগুলোয়ও এখন বাড়ছে পর্যটকদের ভিড়।
পর্যটনকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা। রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৭৯ কিলোমিটার দূরে থাকা এই সৈকতকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র। তথ্য ও গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইমেজ অ্যান্ড ইনফরমেশনের পরিচালক হাসান আবিদুর রেজা বলেন, ভৌগোলিকভাবে ভূখণ্ডের কৌণিক দ্বিবাহুতে অবস্থান কুয়াকাটার। যে কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তেমন একটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে না এই সমুদ্রতট। ১৮ কিলোমিটার প্রস্থের সৈকতে নেই কোনো চোরাবালি কিংবা পর্যটকদের ভাসিয়ে নেওয়া রিপ কারেন্ট। ভাটায় মানুষ না টানা এই সৈকতের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দেখার সুযোগ।
পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ-সদস্য মুহিব্বুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে কুয়াকাটা। এখানে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে অনেক শিল্পগ্রুপ। শুরু হয়েছে কুয়াকাটা, চরবিজয়, ফাতরার জঙ্গল আর রাখাইন জনগোষ্ঠী ঘিরে বিপুল পর্যটকের আগমন।
এছাড়া সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে শুরু করেছে দক্ষিণের আরও অনেক পর্যটনকেন্দ্র। যেসব জায়গায় আগে পর্যটকদের পা খুব একটা পড়েনি। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে জাহাজমারা সমুদ্রসৈকত, চর হেয়ার, সোনারচর, বরগুনার তালতলীর শুভ সন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত, নিদ্রা পর্যটনকেন্দ্র, বিহঙ্গ দ্বীপ, বানারীপাড়ায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বাস্তুভিটা, ঝালকাঠিতে কবি কামিনী রায়ের বাড়ি, বরিশালে মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি ও স্বরূপকাঠিতে পেয়ারা বাগানের জলের রাজ্য। এরকম জানা-অজানা প্রকৃতির অগণিত সৌন্দর্যের রাজ্যে এখন ভিড় করছে মানুষ।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক বরিশাল-১ আসনের সংসদ-সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার মাজার জিয়ারত করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে আসতে চায় অগণিত মানুষ। অনেকে আছেন যারা নদীভীতির কারণে এতদিন আসেননি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর জাতির পিতার মাজার পরিদর্শন এবং জিয়ারত প্রশ্নেও বাড়তে শুরু করেছে ভিড়।