কমল সেনগুপ্ত।। ‘১৯৭১। জ্যৈষ্ঠ মাস। আমার বয়স তখন পাঁচ। মা-বাবা আর দু’বোনের লাশের মাঝে আমি জীবিত ছিলাম। মায়ের শাড়ীর আঁচলের নীচে নিরাপদ আশ্রয়ে আমি গুলিবিদ্ধ বোনকে নিয়ে কাঁদছিলাম। হয়ত ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা আর রক্ত দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম’। কথাগুলো মৃত্যু ছুঁয়ে দেখা কবিতার। ১৯৭১ সালের ১ জ্যৈষ্ঠ বরিশালের আগৈঝাড়ার রাজিহারে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী। হানাদারদের আসার খবর পেয়ে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার কয়েক হাজার মানুষ কেতনার বিলে ঝোঁপে ঝাড়ে লুকিয়ে আশ্রয় নেয়। বেলা ১২ টার দিকে হানাদাররা কেতনার বিলে প্রবেশ করে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। নির্মম এই গণহত্যার পর হানাদাররা কেতনার বিলের পার্শ্ববর্তী পাত্র বাড়িতে গিয়ে এক বাড়িতেই ১৯ জন মানুষকে হত্যা করে। লাশের স্তুপে বেঁচে যাওয়া কবিতা পাত্র বাড়ীর মেয়ে।
ওপরে অসীম নীল আকাশ। নীচে বিলের জলে সবুজ ক্ষেত। সূর্য মাথার উপরে। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিন। কেতনার বিল। গৃহিণীরা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে আর পুরুষেরা উঠোনে বসে তামাক ফুঁকছে। যেখানে ‘বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে। মা বলিতে প্রাণ করে অনচান, চোখে আসে জল ভরে’। এভাবেই কাটছিল ওদের স্বপ্নের দিনগুলো। প্রতিদিনের মত বিলবাসীও তাদের নিজের কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। ব্যস্ত পাত্র বাড়ীর, বাবা বিনোদ পাত্র, মা বিজয়া পাত্র। তিন মেয়ে গীতা, কবিতা আর কানন উঠোনে খেলছে। বাবা হয়তো স্বপ্ন বুনছিলেন। বড় হচ্ছে মেয়েগুলো, বিয়ে দিতে হবে, বর আসবে পালকি চেপে মাথায় টোপর দিয়ে। দেশে শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রাম চলছে। ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছে নিরীহ বাঙালির উপর। আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে স্বপ্নঘেরা কেতনার বিলেও। তবে এত প্রত্যন্ত অঞ্চলে কি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আসতে পারবে? চিনবে কি করে? এমন সময় হঠাৎ দূরে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার। মিলিটারি! মিলিটারি!! মিলিটারি!!! প্রাণে বাঁচতে দূরদূরান্তের মানুষ আশ্রয় নিল কেতনার বিলের ধান ক্ষেতে। হঠাৎ গুলির শব্দে, একটানা গুলির শব্দে ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলতানও যেন বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় বারুদের গন্ধে বিল ছেঁড়ে পালাল ঝি ঝি পোকাগুলো। মানুষ ছুটে আসছে দলে দলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বিল ভরে গেল। কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে কেতনার বিলের নিরাপদ ঠিকানায়। এখানে মিলিটারি আসবে? না মাঠ থেকে রাস্তা অনেক দূর। গুলি করলেও মাঠে হানাদারদের গুলি এসে পৌঁছাবে না। ‘এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে’ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে’। হানাদাররা গুলি ছু্ড়ছে। বিলে হাজার হাজার মানুষের আহাজারি। পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি, মানুষের আহাজারি আর আর্তচিৎকারে নিস্তব্ধ গ্রামও আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। সবাই ছুটতে লাগল নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। স্বপ্ন ভাঙ্গা বিনোদ আর বিজয়া তিন কন্যাকে নিয়ে দৌড় দিলেন উত্তর দিকে। দুটো জমি পেরিয়ে তিন নম্বর জমিতে, প্রায় পাঁচশ গজ দূরে আশ্রয় নিল। কিন্ত হিংস্র দানবের মতো দাঁত তুলে হাসতে হাসতে হানাদারেরা ঢুকলো ওদের গ্রামে। পথ চিনিয়ে দিল স্বদেশী দালালেরা। প্রথমে লুটপাট তারপর আগুন ধরিয়ে দিল ওদের স্বপ্নের ঠিকানায়। লেলিহান শিখায় পুড়ে গেল ওদের ছোট ছোট ঘরগুলো। মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল কবিতার মা বাবাকে। মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল তিন কন্যা। কবিতা দেখলো কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা-মা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, লুটিয়ে পড়েছে বড়দিদি গীতা, পাশেই রক্তাক্ত ছোট বোন কানন। কবিতা জানায়, আমার কিচ্ছু মনে নেই। হয়ত অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। শুনেছি আশপাশের মানুষ যখন আমাদের কাছে গেল তখন আমি কাঁদতে ছিলাম। পাশে পড়েছিল মা-বাবা বোনসহ সমস্ত স্বজনদের লাশ। আদরের ছোট বোন কানন গুলিবিদ্ধ। রক্তে ভেজা শরীর। গুলিবিদ্ধ কানন একফোঁটা জলের জন্য হাহাকা র করছে। কিন্তু কোথায় জল? কেতনার বিলের টলটলে জলে তখন রক্তের স্রোত বইছে। কচুরিপানার মত ভাসছে লাশ। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে কবিতা বলে, ‘আমাদের বাড়ির ১৯ জনকে সেদিন হত্যা করে। সেদিন ছোট বোনটা জল তেষ্টায় চিৎকার করতে করতে লুটিয়ে পরলো মাটির কোলে’। এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেল কবিতা। চোখের জল মুছে আবার বলতে শুরু করল অনাথ শিশুর করুন কাহিনী। ‘বাবা-মায়ের কোলে চেপে আমি বড় হইনি। জানিনা বাবা-মার আদর কেমন?’। পরের দিন পাশের বাড়ির এক জেঠিমা তার বাবার বাড়ী কান্দির পারে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে বাড়ীর অন্যান্য শিশুদের মতই থাকতে বাঁচতে শুরু করে কবিতা। শুরু হয় ঝরাপাতার মত উড়ে উড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ছোট্ট শিশু কবিতা সংগ্রাম কি বোঝে না শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবা-মা-বোনদের খোঁজে আর দুবেলা দুমুঠো ভাত খায়। দেশ স্বাধীন হলে ঠাঁই হয় দূরসম্পর্কের এক কাকার কাছে। বয়স যখন ১২ তখন মামা নিয়ে যায় উজিরপুরের বার পাইক্কার ইন্দুরকানি গ্রামে। মামার বাড়িতে। সেখানে মামাতো ভাই-বোনদের সাথে বড় হতে থাকে কবিতা। কবিতা জানায়, ‘অভাব ছিল, তবে মামা মামী আমাকে কোন কষ্ট দেয়নি’। কবিতার বয়স বাড়ছে। তবে যাওয়া হয়নি স্কুলে, পড়া হয়নি ছড়া বা কবিতা। ১৬-১৭ বছর বয়সে মামা, কবিতার বিয়ে দেন। ছেলে পেশায় কাঠমিস্ত্রি। বর্তমানে সে ঢাকায় বাস করে। মতিঝিলে তার স্বামীর একটি ফার্নিচারের দোকান আছে। তিন মেয়ে, এক ছেলের জননী কবিতা। কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস তার পিছু ছাড়ে না। কেমন ছিল মা-বাবা? দু’বোন? কেন তাদের হত্যা করল পাকিস্তানী হানাদারেরা? ‘এই জনমে কি ফুরাবে ভাই আমার বুকের সেই ক্ষত। দুঃখে বাংলার পদ্মা মেঘনা যমুনা যে উজান বয়’! এভাবেই কবিতার দিন কাটে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের একটি ভাড়া বাসায়।
‘‘দিছি রক্ত জন্মাবধি, সাগর সাগর নদী নদী, রক্তে বাংলা লাল কইরাছি এই কথা তো মিথ্যা নয় আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা…’। গণহত্যার মানচিত্রে রক্তাক্ত একটি নাম আগৈলঝাড়ার কেতনার বিল। লাশের পাহাড়। রক্ত স্রোত আর কবিতার কথা। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কবিতা সেই ছন্দ মেলায়। কেতনার পথে পথে। বিলের ক্ষেতে খেতে। কবিতার ছন্দ আর মেলে না কবিতার কবিতা লেখা হয় অমিত্রাক্ষর ছন্দে।