একজন রাজনৈতিক নেতা তাঁর নিজের দলের রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে জনপ্রিয়তা পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই জনপ্রিয়তা অতিক্রম করে যখন সে গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় তখন তাকে আর রাজনৈতিক গন্ডিতে আটকে রাখা যায়না, তখন সে গণমানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে জননেতা হয়ে যায়। একজন জনপ্রিয় জননেতা দলমত নির্বিশেষে একটি জনপদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আবর্ভূত হয়। কিন্তু জননেতা একদিনে তৈরি হয় না। এর পিছনে প্রেক্ষাপট থাকে। দীর্ঘদিনের মেহনত, জনসম্পৃক্ততা, জনপদের সর্বস্তরে মাটি ও মানুষের মাঝে মিশে যাওয়ার অফুরান প্রাণশক্তি এবং ধীশক্তি ব্যতীত এই অমূল্য মানবিক অর্জন সম্ভবপর হয়না। কিন্তু জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগানে বীজ বপন থেকে ফুল ফুটিয়ে সৌন্দর্য বাড়ালেন যেই মালি সেই সাজানো বাগানের মালিকে নির্বাসিত করলে ফুলে মৌমাছি বসবে কি? মৌমাছি ছাড়া পুষ্টিকর সুস্বাদু মধুর উৎপাদনে ভাটা পড়লে মহাজনের কোষাগারে টান পড়বে, সেই খবর তাঁরা রাখেন কি?
২. হাইকমান্ডের নির্দেশনা, নেতা-কর্মীদের বাধ্যবাধকতা ও তৃণমূলের বাস্তবতা: ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। শৃঙ্খলাই শক্তি ইত্যাদি কেতাবি কথা আমরা বলে কয়ে অভ্যস্ত হলেও বাস্তবতা বিবর্জিত অধিনায়কত্ব দলের ভরাডুবির কারণ হতে পারে। নিজের চামড়া কেটে অন্যের জুতা বানানোকে বদান্যতা বলেনা বরং বোকামি বলে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানতে তৃণমূল বাধ্য থাকে। শৃঙ্খলার স্বার্থে এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু তৃণমূলের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তার গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার থাকাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য। পটুয়াখালী ৩ আসনে যে রাজনৈতিক দলের নেতাকে সহযোগিতা করার অনুরোধ করা হয়েছে তার প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু তাকে কীভাবে সহযোগিতা করবো সেই উপায় আমি বুঝে উঠতে পারছি না। আমার বিশ্বাস আমার অন্যান্য রাজনৈতিক সহকর্মীগণও বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছে না। একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সাথে কোন্দল করা থেকে বিরত থাকতে পারে। কিন্তু সহযোগিতা কীভাবে করতে পারে? সহযোগিতা করা মানে তো সেই দলের মিছিল মিটিং আয়োজনে অংশ নেওয়া, তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশীদার হওয়া। তাহলে কি বিএনপির লোকজনকে দলত্যাগের অনুরোধ করা হলো? দীর্ঘ বছরের পর বছর বিরোধী দলের রাজনীতি করে হামলা মামলার শিকার হয়ে বাড়ি, ঘর, ব্যবসা ছাড়া হয়ে এখন যদি পরজীবী হয়ে রাজনীতি করার নির্দেশনা আসে, সেই নির্দেশনা তৃণমূল কতটুকু মানবে সেটা কী রাজনীতি নিয়ন্ত্রকগণ চিন্তা করেনা?
৩. দক্ষিণবঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, পটুয়াখালী-৩ আসনে ব্যক্তি হাসান মামুনের প্রাসঙ্গিকতা: পটুয়াখালী জেলায় চারটি সংসদীয় আসনে জাতীয়তাদী আদর্শের রাজনীতি জনপ্রিয় হলেও জাতীয় সংসদে আশানুরূপ ফসল বিএনপি ঘরে তুলতে পারেনি। পটুয়াখালী-১ সদর আসনে বর্ষীয়ান নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী ব্যতীত পটুয়াখালী-২, ৩, ৪ আসনে প্রায় প্রতিবারই ধানের শীষের প্রতীক ভোটের রাজনীতিতে হেরে গেছে। পটুয়াখালী-৩ আসনে মরহুম শাহজাহান খান বিএনপির রাজনীতি যতটুকু এগিয়ে নিয়েছেন, তা হাসান মামুনের হাতে পূর্ণতা পাচ্ছে। ছাত্রনেতা থেকে জননেতায় রুপান্তরে তার জনসম্পৃক্ততা ঈর্ষণীয়। সমাজের সকল স্তরে তার গ্রহণযোগ্যতা ব্যক্তি হাসান মামুনকে অনেক ক্ষেত্রে দলের উর্ধ্বে অবস্থান দিচ্ছে। এমন অবস্থায় দল এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগালে দক্ষিণবঙ হতে পারে বিএনপির আরেক বগুড়াসম দূর্গ। ১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের নবীনবরণে যোগদানের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির হাতেখড়ি করে ২০১৬ সালে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে অদ্যাবধি প্রায় ৩৭ বছর যাবত বিভিন্ন পদে থেকে বিতর্কমুক্ত রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পরিচালনা করা কতজন সজ্জন নেতা পাওয়া যাবে সে খোঁজ খবর নেওয়া যেতে পারে। তিনি ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি পদে দায়িত্বশীলতার সাথে যে দায়িত্ব পালন করে দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করে একটি শক্তিশালী সামাজিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছেন তা আমাদের জনপদের জন্য কল্যাণে কাজে লাগাতে তাকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার বিকল্প নেই।
৪. যুগপৎ আন্দোলনে শরিকদের মূল্যায়ন ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মুখ রক্ষার রূপরেখা: আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছেন সেসব শরিকদের অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে গলাচিপা-দশমিনার অন্যতম কৃতসন্তান ভিপি নূরের নাম নিশ্চিতভাবেই প্রণিধানযোগ্য হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর সর্বদা বলিষ্ঠ ছিল। তিনি জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ব্যক্তি। নিজ জন্মভূমিতে তাঁর ভোটের অধিকার আমি ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করি। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা একেবারেই অপ্রতুল। তাই অত্র এলাকার একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনে করি জাতীয় সংসদে আসন নিশ্চিত করতে চাইলে তাকে রাজধানীকেন্দ্রিক যেকোনো একটি আসন থেকে নির্বাচনের চিন্তা করা উচিৎ অথবা ভবিষ্যতে তাঁর মিত্র রাজনৈতিক শক্তি সরকার গঠন করলে সেই সরকারের অংশীদার কীভাবে হওয়া যায় সেদিকে তাঁর মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।
এছাড়াও, নির্বাচনী আমেজ আসার আগেই নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অস্পষ্ট বিভ্রান্তিমূলক চিঠি চালাচালি করে স্থানীয় রাজনীতির সুবাতাস নষ্ট করা কেন্দ্রীয় রাজনীতির ভুল পদক্ষেপ বলে পরিগণিত হতে পারে। আত্মসমালোচনা ও অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যপ্তি বৃদ্ধি পেলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর প্রতিফলন হবে বলে আশা করি। দুর্দিনের নেতা-কর্মীদের লালন না করলে নিজ দলের ত্যাগী কর্মীবাহিনী তৈরি হবেনা। এতে আখেরে রাজনীতির ক্ষতি হবে।
লেখক: মো. মোফাজ্জেল হোসেন
সহ-সভাপতি, দশমিনা উপজেলা বিএনপি, পটুয়াখালী।