আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বরিশাল বাসির দাবির প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন এবং ২০১২ সালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।যদিও ষাটের দশকেই দক্ষিণাঞ্চল, তথা বরিশালে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন হয়। ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পরে, ১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বরিশাল শহরে সমাবেশের মধ্য দিয়ে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন, যা বরিশাল বাসির আকাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে সেটি আর পূরণ হয়নি।
পরবর্তীতে, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বরিশাল সার্কিট হাউসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু বরাবরই বাস্তবায়নের অভাবে বরিশালের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। স্বৈরশাসক এরশাদের শেষ সময় এবং নব্বই দশকের শুরুতে এককভাবে না হলেও যৌক্তিক দাবির সাথে প্রথমেই বরিশালে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি উপস্থাপন হত। আর এ লড়াইয়ে, ছাত্র মৈত্রীর তৎকালীন নেতৃবৃন্দ এবং বরিশালের নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো ।
দীর্ঘ সময় পর আবার ২০০৪-০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে এ দাবি সামনে আসে, তবে সেটা ভিন্ন আঙ্গিকে। ঐতিহ্যবাহী সরকারি ব্রজমোহন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার তোড়জোড় শুরু হয়, তবে বরিশাল বাসির দাবি ছিল স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের, বিএম কলেজের ঐতিহ্য নষ্ট করে নয়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল, সেটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারা বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের লোভ দেখিয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল, আর এ কাজে তৎকালীন কিছু শিক্ষক ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে, শিক্ষার্থী এবং শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়,এতে বহু শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত এবং গুরুতর আহত হয়। যদিও বৃহত্তর ছাত্রসমাজ স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ছিল। ক্ষমতাসীনদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর তৎকালীন নেতা খালিদ বিন ওয়াহিদ জাচ্চু,প্রমথ সরকার, অনুপ কুণ্ডু,আবদুল কাদের, মং চেংলার নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে বিএম কলেজ ও শহরে প্রচারনা এবং মিছিল মিটিং করেছে । শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লাগাতার মতবিনিময় করে বিএম কলেজ অক্ষুণ্ণ রেখে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে জনমত সংগঠিত করে ।
সে সময়ের বরিশালের দুজন সাংবাদিক, আজকের কাগজের মনির এবং ডেইলী স্টারের আনিস তাদের পত্রিকায় ছাত্র মৈত্রীর ভূমিকা নিয়ে লিখেছে, সংবাদ প্রকাশ করেছেন।
বিএম কলেজ কে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রচেষ্টা হালে পানি না পেয়ে, অবশেষে বিএনপি-জামাত জোট সরকার স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কড়াপুর এর ডেফুলিয়ায় স্থান নির্ধারন করে। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে সেই প্রচেষ্টা আর এগোয়নি।
পরবর্তীতে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সময়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জোরালো হয় সে সময়ও বিএম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় না করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য লড়াই অব্যাহত থাকে। তৎকালীন সময়ে বিএম কলেজে ক্রিয়াশীল সংগঠন ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন,জাসদ ছাত্রলীগ বিএম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ভুল দাবির পক্ষে অবস্থান গ্রহন করে,স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতা শামিল শাহরোখ তমাল, সম্রাট মজুমদারের নেতৃত্বে ছাত্র মৈত্রী বিএম কলেজের ঐতিহ্য নষ্ট না করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে মতবিনিময়,মিছিল এবং নগরেও প্রচারনা অব্যাহত রেখেছিল। আর এ কারণে নেতৃবৃন্দকে প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। এসময় বিএম কলেজের কিছু রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী,বেশ কজন শিক্ষক এবং নগরের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। অবশেষে, ২৯ নভেম্বর ২০০৮ সালে তৎকালীন ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিন সরকার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব একনেকে পাস করে, কিন্তু একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। তবুও এটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় দাবির লড়াইয়ের প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত করে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল ক্ষমতাসীন হলে ২০০৯ সালের ৩০ মে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর বরিশাল বিভাগীয় শিক্ষা সম্মেলন সরকারি বিএম কলেজের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়, এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি জননেতা রাশেদ খান মেনন এমপি,সেই সম্মেলন সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শামিল শাহরোখ তমাল, সভাপতিত্ব করেছিলেন জেলা আহবায়ক আবুল কালাম। সম্মেলনের আগের রাতে কলেজ ক্যাম্পাসে “বিএম কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চাই” কে বা কাদের দেয়াল লেখার প্রেক্ষিতে ছাত্র মৈত্রী “স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চাই” পাল্টা দেয়াল লিখেছিল । সম্মেলনের শেষ পর্বে সকলের জন্য উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল, যার সরাসরি উত্তর দিয়েছেন কমরেড মেনন, তিনি তার বক্তব্য এবং প্রশ্নোত্তরে সকল শিক্ষার্থী, সুধীজনদের সম্মুখে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করে একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর দাবিকে সামনে নিয়ে আসেন, ফলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করার দাবি আরো জোরালো হয় এবং ছাত্র মৈত্রীর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছিল । এর বছর খানেক পরে ০৬ আগস্ট ২০১০ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বরিশালের শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ প্রফেসর হানিফকে আহ্বায়ক এবং বাহাউদ্দীন গোলাপকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন হয় যেখানে শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের অন্তর্ভুক্তি ছিলো। সেই কমিটিকে বরিশালের নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন সমর্থন দিয়েছিল, ছাত্র মৈত্রীর সহযোদ্ধারা প্রচারপত্র বিলি, মিছিল, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান এবং বরিশাল স্থবির করা সহ সকল কর্মসূচিতে দায়িত্ববোধ এবং দাবি আদায়ের প্রশ্নে সামনের সারিতে থেকেছেন। বরিশালের সন্তান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সংসদীয় কমিটির সভাপতি, ২০১০ শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য জননেতা রাশেদ খান মেনন এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তিনি বরিশালে এসে এই দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণার পাশাপাশি বাস্তবায়ন কমিটি কে নানাবিধ পরামর্শ দিয়েছেন। একইসাথে সংসদে দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পক্ষে কথা বলেছেন। তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরনের আন্তরিকতা এবং ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছায়, বরিশাল বাসির জন্য তার উপহার হিসাবে দেশের ৩৩ তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় “বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ” এর ক্যাম্পাস উদ্বোধন করেন ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর। স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য নির্ধারিত স্থান কর্ণকাঠীতে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয়দের সাথে সংকটের সৃষ্টি হয় , ক্যাম্পাসের জন্য যারা বসতভিটা হারিয়েছেন তারা নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন, যা মামলা পর্যন্ত গড়ায় এবং রাষ্ট্রপক্ষের জয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। সেখানেও আমাদের পার্টির তৎকালীন নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, বৃহত্তর স্বার্থে সামান্য ক্ষতি মেনে নেয়ার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করেন, পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারী পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে বরিশাল জিলা স্কুলের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। “জ্ঞানই শক্তি” নীতিবাক্য ধারণ করে ৪০০ শিক্ষার্থী ও ৬টি বিষয় নিয়ে বরিশাল জিলা স্কুলের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ০৬ টি অনুষদসহ ২৪ টি বিভাগে প্রায় ৯,০০০ জন শিক্ষার্থী (সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী) অধ্যয়নরত।
যদিও নানাবিধ সংকট বিদ্যমান, এখনো শিক্ষকসহ জনবলের ঘাটতি রয়েছে, পর্যাপ্ত গবেষণাগার নেই। আবাসন এবং পরিবহন সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি। বরিশাল বাসির লড়াইয়ের ফসল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সকল সংকট কাটিয়ে শিক্ষা এবং গবেষণার পাশাপাশি প্রগতিশীল, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে দেশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, সেটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
শামিল শাহরোখ তমাল
প্রাক্তন ছাত্র নেতা