আপডেট: জুন ১৪, ২০২১
সনৎ কৃষ্ণ ঢালী, স্টাফ রিপোর্টার:
১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য।
১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে।
প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়, অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবনসংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম।
স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদানকারী আড়ালে থাকা সেসব মানুষের উদ্দেশে, এসব অজানা বীরের উদ্দেশে, উৎসর্গীকৃত ১৪ জুনের বিশ্ব রক্তদান দিবস। ১৪ জুন দিবসটি পালনের আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। এদিন জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের। এই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন রক্তের গ্রুপ ‘এ, বি, ও,এবি’ ।
আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ব্যাগ রক্ত লাগে। এর কেবল ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাকি ৭০ শতাংশ আসে রক্তগ্রহীতার স্বজন ও অপরিচিতদের কাছ থেকে। দেশে নারীদের মধ্যে রক্ত দেওয়ার সুযোগ ও প্রবণতা কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, রক্তদাতাদের মধ্যে কেবল ৬ শতাংশ হচ্ছেন নারী।
এদিকে গত বছর করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময় বেড়েছিল রক্ত ও রক্তের উপাদানের চাহিদা। জরুরি প্রয়োজনের সময় রক্ত ও রক্তের উপাদানের সংকটের কথাও গণমাধ্যমে এসেছে। এর বিপরীতে করোনাভীতির কারণে মানুষ ঘর থেকে কম বেরিয়েছে। এ কারণে রক্তের সরবরাহও কম ছিল।
সরকারের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ৯ লাখ ৪২ হাজার ১৭২ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে গ্রহীতাদের দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে তা কমে আসে ২০২০ সালে। গত বছর সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ ব্যাগে। এই রক্তদাতাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই পুরুষ।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। বিশ্বব্যাপী স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘রক্ত দিন, পৃথিবীকে বাঁচান’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন অনেক জীবন বাঁচায়। রক্তের চাহিদা চিরন্তন। কিন্তু যাদের প্রয়োজন, তাদের সবার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করা সহজ কাজ নয়। প্রসূতির সিজারের সময়, দুর্ঘটনাকবলিতদের চিকিৎসায়, অস্ত্রোপচারের সময় এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত রক্তের দরকার হয়। রক্তদাতার হেপাটাইটিস-বি, সি, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিস পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশুদ্ধ রক্তের সরবরাহ প্রকট।
রক্তদানে মানুষের মধ্যে দিন দিন সচেতনতা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে এখন খুব কম সময়েই রক্ত মিলে যায়। সারা পৃথিবীতেই রক্ত সংগ্রহ করা হয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে। বাংলাদেশে অবশ্য চিত্রটা উল্টো। এখানে রক্তের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ হয় স্বজন ও অপরিচিতদের মাধ্যমে।
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকা নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এসব কারণে নারীরা রক্তদানে কম উৎসাহ পান।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মেডিকেল অফিসার জাহিদুর রহমান বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগেও রক্ত দিতে নারীরা সংখ্যায় অনেক কম আসতেন। তবে এখন কিছুটা বেড়েছে। রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের আরও উৎসাহ দেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, ভাই-বোন, স্বজনদের মাধ্যমে রক্ত পরিসঞ্চালন নিরাপদ নয়। কাছের আত্মীয়দের থেকে রক্ত নেওয়া হলে ‘গ্রাফট ভার্সেস হোস্ট ডিজিজ’–এর মতো দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি থাকে। এ কারণেই স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে রক্ত নেওয়াটা বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তিনি জানান, স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে রক্তদানের চিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে।
তাই আমাদের প্রত্যেক সচেতন নাগরিক এবং স্বেচ্ছাসেবীদের উচিত রক্তদানে এগিয়ে আসা । রক্ত দানের ফলে রক্তদাতার অনেক উপকারী দিকগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
✓ ওজন হ্রাস: সময়মতো রক্তদান ওজন হ্রাস করতে এবং সুস্থ বয়স্কদের ফিটনেস উন্নত করতে সহায়তা করে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, এক পাউন্ড রক্ত অর্থাৎ ৪৫০ মিলি আপনার দেহকে প্রায় ৬৫০ ক্যালোরি বার্ন করতে সহায়তা করে। তবে এটি ওজন হ্রাস পরিকল্পনা হিসাবে ভাবা বা উৎসাহিত করা উচিত নয়। কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা এড়াতে রক্ত দেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
✓ হিমোক্রোমাটোসিস প্রতিরোধ করে: রক্তদান ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে বা হিমোক্রোম্যাটোসিসের বিকাশকে বাধা দিতে পারে, এমন একটি শর্ত যা শরীরের দ্বারা আয়রনের একটি অতিরিক্ত শোষণ রয়েছে। নিয়মিত রক্তদান লোহার ওভারলোডকে হ্রাস করতে পারে, তাই এটি হেমোক্রোমাটোসিস আক্রান্তদের জন্য উপকারী প্রমাণ করে। তবে রক্তদানের যোগ্যতার মানদণ্ডের বাধ্যতামূলক মানদাতা হিমোক্রোম্যাটোসিসের সাথে দাতা পূরণ করেছেন কিনা তা নিশ্চিত করা জরুরী।
✓ হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করুন: নিয়মিত রক্তদানের ফলে আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করা যায় যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। দেহে প্রচুর পরিমাণে আয়রন তৈরির ফলে অক্সিডেটিভ ক্ষতি হতে পারে যা বার্ধক্য, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদিকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে একটি বড় অপরাধী হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে
✓ক্যান্সারের কম ঝুঁকি: শরীরে আয়রনের উচ্চ মাত্রা ক্যান্সারের জন্য একটি আমন্ত্রণ । রক্ত দানের মাধ্যমে, আপনি স্বাস্থ্যকর আয়রনের স্তর বজায় রাখতে পারেন, যার ফলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
✓নতুন রক্ত কোষের উৎপাদন বাড়ানো: রক্তদান নতুন রক্ত কোষের উত্পাদনকে উদ্দীপিত করে। রক্তদানের পরে, আপনার দেহের সিস্টেম অস্থি মজ্জার সাহায্যে অনুদানের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে কাজ করতে শুরু করে। নতুন রক্তকণিকা তৈরি করা হয় এবং সমস্ত হারিয়ে যাওয়া লোহিত রক্তকণিকা ৩০ থেকে ৬০ দিনের ব্যবধানে প্রতিস্থাপন করা হয়। অতএব, রক্তদান গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
সকল সুস্থ সবল প্রাপ্তবয়স্ক সচেতন নাগরিকদের প্রতি বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে আহ্বান প্রয়োজনীয় দুঃসময়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। মানবিকতার প্রমাণ রাখুন। দেশের প্রতি আপনার ভালবাসা প্রকাশের সুযোগ গ্রহণ করুন।