আপডেট: জানুয়ারি ৪, ২০২০
বাংলাদেশে তাঁর জন্ম না, নেই রক্তের কোনো বন্ধনও। তবু অদ্ভুত এক বন্ধনে আবদ্ধ এ দেশের সঙ্গে। তিনি বাংলা বলেন, বাঙালিদের মতো শাড়ি পরেন। প্রায় ৬০ বছর আগে কাজের তাগিদে নিজের দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশে। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগেই সহকর্মীরা সবাই চলে গেছেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই এখানে। তার পরও তিনি জন্মভূমিতে ফিরে যাননি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ই ব্রিটেনে বন্ধু ও স্বজনদের চিঠি লিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা দিয়েছেন। গল্পটা ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টের। এখনো বাঙালিদের সেবা করে যাচ্ছেন, বাংলাদেশময় জীবন তাঁর। মানুষটা ভিনদেশি হলেও মন ও মননে বাঙালি।
লুসি একা থাকেন বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে। সেখানে হাসপাতালের একটি কক্ষে তাঁর বসবাস। পেয়েছেন এ দেশের নাগরিকত্ব। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সম্প্রতি লুসির কথা হয় মিশনের হোস্টেল পুকুরের সিঁড়িতে বসে। লুসি কথা শেষ করে নিয়ে যান মিশনের ভেতরের কবরস্থানে।
হাত দিয়ে ইশারা করে বলেন, ‘আমি এই এইখানে মারা যাব। আমার মৃত্যু হলে আমাকে যেন এইখানে কবর দেওয়া হয়।’ এটাই হয়তো লুসির ভালোবাসা। তিনি ভালোবেসেছেন বাংলাদেশ। ভালোবেসেছেন বরিশাল। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান বরিশাল শহরেই। বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধেই ঘুমাতে চান চিরদিনের জন্য। সে জন্য লুসি ঠিক করে রেখেছেন নিজের কবরও।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ১৬ ডিসেম্বর। লুসির জন্মও এই দিনে, ১৯৩০ সালে যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে। তিনি বলেন, ‘কাকতালীয় হলেও বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায়। হয়তো এটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার জীবনের একটা গভীর যোগসূত্র রয়েছে।’
লুসির বাবা জন হল্ট ও মা ফ্রান্সিস হল্ট। দুই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। তাঁর বড় বোন রুৎ অ্যান রেভা ফেলটন। স্বামী ও তিন ছেলে নিয়ে তিনি ব্রিটেনেই বসবাস করেন।
লুসি ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক (দ্বাদশ) পাস করেন। ১৯৬০ সালে এ দেশে আসেন। যোগ দেন বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে। এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়াতেন। এরপর আর দেশে ফিরে যাননি। ঘুরেফিরে তিনি কাজ করেছেন যশোর, খুলনা, নওগাঁ, ঢাকা ও গোপালগঞ্জে। ২০০৪ সালে অবসরে যান লুসি। ওই বছরই তিনি ফিরে আসেন বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনে।
বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন প্রাঙ্গণে টিনের ছোট্ট একটা ঘর, পুরনো জরাজীর্ণ। বারান্দার এক অংশে লুসির থাকার ব্যবস্থা। সেখানে আসবাব বলতে ছোট একটি কাঠের চৌকি, কাঠের ছোট দুটি টেবিল। পাশে একটা তাকে কিছু বই ও পুরনো ডায়েরি সাজিয়ে রাখা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বর্তমানে তাঁর ঠাঁই হয়েছে মিশনের হাসপাতালের একটি কক্ষে।
বয়স তাঁর নব্বই ছুঁই ছুঁই। অবসর মিললেও জনকল্যাণ থেকে নেননি অবসর। তিনি এখনো দুস্থ শিশুদের মানসিক বিকাশ ও ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
১৯৭১ সালে যশোর ক্যাথলিক চার্চ স্কুলে শিশুদের ইংরেজি পড়াতেন লুসি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চার্চটি বন্ধ করে মিশনের সবাই খুলনায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে যুদ্ধ-মৃত্যু-বিভীষিকার মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ান। মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরে ফাতেমা হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের সেবা দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিক থেকেই ব্রিটেনে বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখতেন লুসি। ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গুণমুগ্ধ। সে সব চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। সেই সঙ্গে থাকত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা। বন্ধুদের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাড়াও পেয়েছেন তখন।
লুসি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে আমি এতটাই শ্রদ্ধা করতাম যে ১৯৭২ সালে আমি নিজ হাতে ডাইনিং টেবিলের ম্যাট ও চেয়ারের কুশন বানিয়ে তাঁর স্ত্রীর জন্য পাঠিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা মায়ের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে প্রত্যুত্তরে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।’
লুসির ভাষায়, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে পারা আমার বিশাল সৌভাগ্য।’ স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সরকারি স্বীকৃতি না মিললেও যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় বিজয় দিবসে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ লুসিকে সম্মাননা দিয়েছে।
লুসি বলেন, ‘ডাক্তার না হয়েও অনেক মানুষকে সে সময় চিকিৎসা দিয়েছিলাম। তখন একে তো ছিল ডাক্তারের স্বল্পতা। তার ওপর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় অনেক ডাক্তারই হাসপাতালে আসতে ভয় পেতেন। আর মাত্র কয়েকজন ডাক্তারের পক্ষে সবার দেখভাল করাও সম্ভব ছিল না।’
মুক্তিযোদ্ধাই হোক আর সাধারণ জনগণ, সবাইকেই সাধ্যমতো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। এমনও সময় গেছে, যখন বুলেটের ক্ষতের চিকিৎসাও তাঁকেই করতে হয়েছে।
শুদ্ধ বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করেন লুসি। জানান, বিনে পয়সায় কখনো সেলাই শেখানো, তাঁত প্রশিক্ষণ, পথশিশুদের পাঠদান, আবার কখনো বা হাসপাতালে সেবা দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়।
নামমাত্র উপার্জন বলতে বাংলায় অনুবাদ। কেউ কেউ লুসির কাছে আসেন ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য। আবার কেউবা আসেন বাংলা থেকে ইংরেজি করাতে। আর এসব কাজ করেন তিনি হাসিমুখে। যদিও ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় ৭০ পাউন্ড বা হাজার ছয়েক টাকা পান মাসিক ভাতা হিসেবে। তাও অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেন। লুসির সঞ্চয় বলতে কেবলই বাঙালিদের ভালোবাসা।
অক্সফোর্ড মিশনের ম্যানেজার বেনিডিক্ট বিমল ব্যাপারী বলেন, দীর্ঘ বছর ধরেই লুসিকে চেনেন তিনি। সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত মানবদরদি এ মানুষটির এ দেশে রক্তের কেউ না থাকলেও আত্মীয়তা করেছেন অনেক বাঙালির সঙ্গেই। তাঁর মেয়ে, মেয়ে জামাই, আদরের নাতি-নাতনি রয়েছে। যদিও তারা কেউই রক্তের তো নয়, বিদেশিও নয়—সবাই এ দেশেরই। লুসির ভাষায়, তঁরা এ বন্ধন আত্মিক।
লুসি হল্টের একসময়ের ছাত্রী ৫৯ বছরের ঊষা দাস। তাঁর নাতিকেও ধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন লুসি। পরিবারের আরো কয়েকজনকে ধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন। ঊষা দাস বলেন, তিনি (লুসি হল্ট) শুরু থেকেই মানুষের সেবা করেছেন, এখনো মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। তাঁকে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললেই তিনি কাঁদেন। এ দেশের মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।
লুসিকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যত না প্রচার হয়েছে, তার চেয়েও বেশি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর নেপথ্যে ছিলেন দিপু হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, লুসিকে এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা কেবলই তাঁর স্বীকৃতির জন্য নয় বরং কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের বন্ধুত্বের প্রমাণ হিসেবেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সফিকুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি লুসির ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান দুটোই আমাকে সম্মোহিত করেছে। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর ভিসা নবায়ন, দ্বৈত নাগরিকত্বের ব্যাপারে উদ্যোগ নিই। ভিসা ফি মওকুফের পাশাপাশি ১৫ বছরের জন্য তাঁকে এম ক্যাটাগরিতে মাল্টিপল ভিসার ব্যবস্থা করেছে সরকার।
পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণভবনে লুসির হাতে নাগরিত্ব সনদ তুলে দেন।’ সফিকুজ্জামান জানান, লুসিকে নিয়ে একটি ফাউন্ডেশন গঠনের পরিকল্পনাও দ্রুত এগিয়ে চলছে।