আপডেট: জানুয়ারি ২০, ২০২০
মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত আধুনিক বরিশালের রূপকার । তাঁর পরিচয় এক কথায় বলা মুশকিল । তিনি একাধারে সমাজ সংস্কারক , সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত । বরিশালের নির্মাতা হিসেবে যে দু’জন ব্যক্তি স্মরণীয় ও বরণীয় তাদের একজন শের – ই – বাংলা এ. কে ফজলুল হক অন্যজন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ।
গৌরনদী উপজেলার ১৮২৬ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের মুন্সেফ পদে কর্মরত । তাঁর ছিলেন বানারীপাড়া উপজেলার কিশোর গুহ’র (ঠাকুর) কন্যা শ্রীমতি প্রসন্নময়ী ।
তিনি স্বদেশী আন্দোলনের যুগ ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম নেতা ছিলেন । রাজ নারায়ন বসু তাঁকে বলেছিলেন , তুমি যদি কাজ করতে চাও তবে বরিশালে থাকিও । অশ্বিনী কুমার দত্ত রাজ নারায়ণ বসুর কথা রেখেছিলেন । তিনি ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন স্কুল এবং ১৮৮৯ সালে ১৪ জুন বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি বিএম স্কুল ও কলেজে বিনা বেতনে ১৭ বছর চাকরি করেন । অধিকন্ত তিনি বিদ্যালয়ের উন্নয়নে 35 হাজার টাকা দান করেন ।
তিনি ১৮৬৯ সালে ১৪ বছর বয়সে ঢাকা হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৭১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে হতে এফ. এ পাশ করেন । ১৮৭২ সালে বিএ পড়ার সময় নলছিটি উপজেলার ন্থুল্লাবাদের কায়স্থ কন্যা ৯ বছর ৪ মাস বয়সী সরলা বালাকে বিয়ে করেন ।
তিনি স্বেচ্ছায় দাম্পত্যজীবন নির্বাসন দিয়ে ব্রহ্মচারী জীবন বেছে নেন । তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, তোমার সাথে আমার মিলন হবে না । আমি কোন সন্তানের জনক হবো না । আমি যদি পিতা হই , তাহলে আমার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে । বরিশাল এর ছেলেমেয়েরা আমার সন্তান । তাদের মানুষ করা আমার কর্তব্য। তার স্ত্রী স্বামীর পথ অনুসরণ করেন । সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে তিনি বরিশালের জনগণকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপন করে নিয়েছিলেন । তাইতো তিনি মহাত্মা ।
অশ্বিনীকুমার দত্ত ১৮৭৬ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বিএ পাস করেন । ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ এবং ১৮৮০ সালে বি. এ পাস করেন । ওই বছরই তিনি বরিশাল জজ কোর্টে ওকালতি শুরু করেন । বরিশালে তিনি প্রথম এল. এ. এল. এল. বি ।
অল্প সময়ে তিনি একজন খ্যাতনামা আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন । তিনি বরিশালের সমাজের নানা কুসংস্কার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচি তিনি একই সাথে গ্রহণ করেন ।
তিনি ছিলেন বরিশালের গৌরব । আধুনিক বরিশালের নির্মাতা । সাধনা, নিষ্ঠা, মানব প্রেম ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক । বঙ্গভঙ্গ হতে স্বদেশী , স্বদেশী হতে স্বাধীনতার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে অশ্বিনী কুমার দত্ত বাঙালি জাতির কাছে চিরস্মরণীয় , চির পূজনীয় ।
অশ্বিনী কুমার দত্ত ছাত্রজীবনে রামতনু লাহিড়ী , রাজনারায়ন বসু, কেশব চন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরম হংস ও স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে দীক্ষা লাভ করেন । তিনি ব্রাহ্মসমাজ এর সদস্য হন এবং সনাতন সমাজের চাপে পুনরায় সনাতন ধর্মে ফিরে আসেন । বরিশালের বাজার রোডের কালী বাড়ির সোনা ঠাকুরকে তিনি পরম শ্রদ্ধা করতেন ।
বৃটিশ সরকার ১৯০৮ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে রেঙ্গুনে ও পরে আগ্রায় বন্দি করে রাখে। ১৯১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি লাভ করেন । বরিশাল এ ফিরে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে । তিনি বহুমুত্র ও জটিল পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন ।
১৯২২ সালে আগস্ট মাসে তিনি চিকিৎসার জন্য কলকাতা গমন করেন । সেখানে তিনি এক বছর তিন মাস ছিলেন । ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর বুধবার ৩টা ৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাসঐ ত্যাগ করেন। ঐ দিন রাতেই কালীঘাট কেওড়াতলায় তার মরদেহ দাহন করা হয়। সেখানে আজও তার স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।