আপডেট: নভেম্বর ১০, ২০২৩
বাঙালী জাতি আমোদ প্রমোদ প্রবন জাতি। ঐতিহ্যগতভাবেই বছর জুড়েই থাকে কোনো না কোন আচার অনুষ্ঠান উৎসব। নাইওর এর মধ্যে অন্যতম অনুভুতির নাম। নাইওর বলতে মুলত বুঝায় বিবাহিত বাঙালি মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি হতে বাবার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে আসার একটি ঐতিহ্যগত আয়োজনকে। বিবাহিত বাঙালি মেয়েদের সারা বছরের সাধ ছিলো এই নাইওর। অন্ধরমহলে বসবাস করা বিবাহিত নারীরা সারা বছর অপেক্ষা করতো কবে তাদের বাবার বাড়ি থেকে বাবা – ভাই কিংবা দায়িত্বশীল কেউ তাদের নিতে আসবে। বাঙালি বধুরা আকাশের পানে তাকিয়ে ভাবতো হয়তো উড়ে যাওয়া ওই পাখিটা হয়তো তার বাবা দেশের। এ নিয়ে নিয়ে যুগে যুগে লেখা হয়েছে কতনা গীত। কোনো এক নীরব বিকেলে দূর থেকে ভেসে আসে কাহারদের হাকাহাকির মৃদু শব্দে দৌড়ে এসে বাড়ির নতুন বিয়ে হওয়া বউটা অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে দুরের পালকির পানে। মনে জাগে কত রোমাঞ্চকর অনুভুতি যা লিখে প্রকাশ সম্ভব না। ভাবে আমিও কবে যাবো বাজানের দ্যাশে………।
বাঙালি মেয়েদের নাইওর নিতে আসার কারন হলো মুলত উৎসকে কেন্দ্র করে যেমন কৃষকের ঘরে নতুন ধান রবি শস্য উঠার পরে শীতে এবং জৈষ্ঠ্যমাসে আম কাঁঠাল পাকার সময় জামাই ষষ্ঠীতে বাংলার কৃষক পরিবার গুলোতে পরিবারের বিবাহিত মেয়েদের নাইওর আনা হতো। অন্য কারন হলো বাঙালি মেয়েদের প্রথম সন্তান গর্ভে থাকার সপ্তম মাসে মেয়েকে বাবার বাড়িতে এনে অনাগত সন্তানের কল্যান কামনা করে সাত দেওয়া নামে একটা অনুষ্ঠান করা হতো, যা এখন বিলুপ্ত। একেই সাথে নিয়ম অনুযায়ী প্রথম সন্তানের জন্ম বাবার বাড়িতে হতে হয় তাই মেয়েদের নাইওর আনা হতো। মেয়েকে বাংলার পরিবার গুলোতে সব সময় দেবী বা ঈশ্বরের আর্শীবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই পিতামাতাও সবসময় মেয়েদের নাইওর আনার মাধ্যমে মেয়ের মুখ দেখতে ব্যাকুল হয়ে থাকতো। গ্রাম বাংলায় অঞ্চল ভেদে নাইওর আনার জন্য বিভিন্ন বাহনের ব্যবহার ছিলো। নদী অঞ্চলগুলোতে বাহরি নৌকা ছিলো বাহন আর বাকি এলাকায় পালকিই ছিলো নাইওরের প্রধান বাহন। আর দরিদ্র পরিবারগুলো কম দূরত্বের পথ (৪-৫ মাইল) পায়ে হেঁটে যেতো আর দূরত্ব বেশি হলে সাধারণ নৌকা ব্যাবহার করতো। নাইওরের খাবার সম্পর্কে যদি বলা হয় তবে বলতে হয় অঞ্চল ভেদে নানা রকম বাহারি পিঠাপুলি বড় মাছ মাংস ইত্যাদি। তবে ইলিশ মাছ একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। খাবার আপ্যায়ন মুলত নির্ভর করতো বাবার বাড়ি আর্থিক সঙ্গতির উপর। তবে মোট কথা খাবার – আতিথিয়তা যাই হোক না কেনো মেয়েদের চেহারায় একটা প্রশান্তির ছায়া দেখা যেতো।
নাইওর শেষে শ্বশুরবাড়ি ফেরার দিন ঠিক হলে বাবার বাড়ির নাইওরের উপহার হিসেবে মেয়ে- জামাই- নাতি – নাতনী সবার জন্য পোষাকের ব্যবস্থা করা হতো। আর্থিক অবস্থা ভালো হলে গহনাও মেয়ে- জামাই উপহার হিসেবে পেতো। মেয়ের বাবা মায়ের সব সময় একটা চেষ্টা থাকতো যে কোনো কারনে যেনো মেয়ের মুখ শ্বশুর বাড়িতে ছোট না হয়। এবার মেয়ে বিদায়ের দিন এলে বাবার বাড়ি থেকে মুড়ি,মোয়া, মুরকী,নারু,পিঠা, গুড়, আম, কাঁঠাল ফলমূল, পুকুরের বড় মাছ, সাথে আরও অনেক কিছু মায়েরা মেয়েদের সাথে দিয়ে দিতেন। নদীর ঘাট পর্যন্ত বাড়ির ছেলে- বুড়ো- ঝি – বউ সকলে তাদের মেয়েকে বিদায় জানাতে সাথে যেতো। যাওয়া সময় প্রথমেই মাকে জড়িয়ে ধরে মা-মেয়ের আবেগ তাড়িত কান্না যা দেখে বাড়ির সকল ঝি বউয়েরা আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের জল ফেলতো। নদীর ঘাট পর্যন্ত যেতে মা মেয়ে অবিরত ধারায় কান্না করতো । যখন নৌকা ছেড়ে দিতো, যতক্ষন পর্যন্ত নৌকা দেখা যেতো ততোক্ষন মা তাকিয়ে থাকতো। এই আবেগ ভালোবাসা অনুভুতি এটা কখনো বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কমেনি তাদের বরং তা প্রগাঢ় হয়েছে। নাইওর এর প্রচলন এখন প্রায় শেষ বলা যায় এর কারন হলো মুলত বেশ কয়েকটি। এক আমাদের একান্নবর্তী কৃষক পরিবার গুলো ভেঙে একক পরিবার গঠন। দ্বিতীয় কারনটি হলো বলা যায় যোগাযোগ মাধ্যমের অভূতপূর্ব উন্নতি। সহজেই এখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ করা সম্ভব। তার আমাদের প্রিয়জনের প্রতি হৃদয়ের ব্যাকুলতা কমে গেছে।
তিন সভ্যতার সচেতনার জন্য বাল্য বিবাহ অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। এছারাও রয়েছে নানা কারন যেমন রুচি বোধের পরিবর্তন, বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, নারীদের বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণের প্রবনতা, ছেলেমেয়েদের পরাশুনার জটিল কাঠামো প্রভৃতি।
এখনো বাংলার বঁধুদের বাবার বাড়ির প্রতি অনুভুতি সংকোচিত হয়নি। বরং এখনো বঁধুদের হৃদয় পটে কান পাতলে শোনা যায় সেই বিখ্যাত গান..
“কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে কইও নাইওর নিতো বইলা।
তোরা কে যাস কে যাস
কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে কইও নাইওর নিতো বইলা।”
লেখক : তরিকুল ইসলাম
সাংস্কৃতিক সংগঠক
বরিশাল