আপডেট: অক্টোবর ১৮, ২০২৩
বরিশাল
চলে গেলেন পরোপকারী সাংবাদিক, আইনজীবী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষানুরাগী সমাজসেবক ও সংগঠক এসএম ইকবাল (৭৯)। বুধবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে বরিশাল শের ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে তিনি মারা যান। এসএম ইকবাল দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থাবস্থায় বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। বুধবার অসুস্থতা বাড়লে স্বজনরা শেবাচিম হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
এস এম ইকবাল ১৯৪৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার লবনসাড়া গ্রামের সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ শামসুল হুদা এবং মায়ের নাম ফরিদা বেগম। প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবনে ৩য় শ্রেণিতে বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬৪ সালে বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এস এম ইকবাল। স্বাধীনতার পরে সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্যতীর্থ এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করেন তিনি।
সাংবাদিক হিসেবে বরিশালের সংবাদ জগতে আলোকিত নাম এস এম ইকবাল। সত্তরের দশক থেকে তিনি এ পর্যন্ত ঢাকা ও বরিশাল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। এ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ, জনপথ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক দেশ, নিজের সম্পাদনায় ‘কথা’, বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের বার্তা’র সম্পাদক ও সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষ তিনি বরিশালের আজকাল পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি ও দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকার সম্পাদক পদে ছিলেন।
বরিশাল প্রেসক্লাবের ৮ বার নির্বাচিত সভাপতি ও ৫ বার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন এস এম ইকবাল। সাংবাদিকতায় মাইনুল হাসান স্মৃতি পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এ সাংবাদিক।
ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষাজীবন থেকে রুচিশীল এবং আধুনিক চিন্তার এসএম ইকবাল তার স্বপ্ন পূরণে যোগ দেন সেই সময়ের শক্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা বরিশালের সন্তান সাদেক খানের চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা ‘লুব্ধক ফিল্ম’-এ। কারওয়া, নদী ও নারী, আকাশের রং নীল, ক্যায়সে কাহু নামক সময়ালোচিত চলচ্চিত্রগুলোতে কাজ করেন সহকারী প্রোডাকশন কন্ট্রোলার হিসেবে। এফডিসির সেই সময়ের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সম্পাদক আবদুর রহমান আদরের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
এরপরে ধর্মপ্রাণ পরিবারের সন্তান এস এম ইকবাল বাবা ও চাচার নির্দেশে চলচ্চিত্রের রঙিন জগৎ ছেড়ে মনে অভিমান চেপে ফিরে আসেন বরিশালে। এখানে এসে গড়ে তোলেন সামাজিক সংগঠন ‘বরিশাল যুব সংঘ’। নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন, আবৃত্তি, খেলাধুলাসহ সকল সামাজিক ক্ষেত্রে কাজ করতো এ যুব সংঘ।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমরাস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে এ যুব সংঘের সদস্যরা নানা ধরণের দেশীয় অস্ত্র উদ্ভাবন করেন। বরিশাল শহরের সদর রোডের একটি ঘরে যুব সংঘের কর্মকাণ্ড চলতো। পরে কালিবাড়ি রোড ধর্মরক্ষিণী ভবনে গোপনে এ যুব সংঘের সদস্যরা বোমা বানানোর কাজ শুরু করেন। যুব সংঘ মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখে। এ সময়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম পত্রিকা, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। এস এম ইকবাল এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত দলিলের ৬ষ্ঠ খণ্ডে উল্লেখ রয়েছে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধকালীন লুণ্ঠিত সম্পদের হিসাব সংরক্ষণের দায়িত্ব পায় যুব সংঘ। যার সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন এস এম ইকবাল। সাহিত্য সচেতন এস এম ইকবাল ১৯৭২ সালে কলকাতার সাহিত্য গবেষক দিলীপ কুমার দাসের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন জীবনানন্দ দাশ এর ‘রূপসী বাংলা’। তখন জীবনানন্দ দাশের রচনাবলী খুব বেশি সংখ্যক মানুষের সংগ্রহে ছিল না। সেই থেকে শুরু। একে একে সম্পাদনা করতে থাকেন জীবনানন্দ দাশ এর ‘বনলতা সেন’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘সুকান্তের ঘুম নেই’ ইত্যাদি গ্রন্থ। এছাড়া মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে ‘ছোটদের নজরুল’, ‘ছোটদের রবীন্দ্রনাথ’, ‘ছোটদের শরৎচন্দ্র’সহ প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ।
১৯৭৩ সালে জনসমর্থনে নির্বাচিত হন বরিশাল পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার। ১৯৭৪ সালে দু’বার দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে। ১৯৮৫ সালে বানারীপাড়া উপজেলার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পদাধিকার বলে বানারীপাড়া উপজেলার ২৭টি বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। এই শিক্ষানুরাগী মানুষটি বাইশারীতে একটি স্কুল ও একটি কলেজ নির্মাণ করেন।
বরিশালের ইতিহাসে আরও একটি আবেগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এস এম ইকবালের নাম। বরিশালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটির অন্যতম শক্তিমান ও পরিশ্রমী সদস্য এ আজন্ম অসাম্প্রদায়িক মানুষটি।
এসএম ইকবাল অমর একুশের গান হিসেবে খ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার সংস্কৃতিকর্মী ও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের নামে ১৯৭২ সালে বরিশালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়’।
এছাড়া ২৮টি সংগঠনের জোট বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের তিনি দু’বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি উদীচী বরিশাল জেলা সংসদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অর্ধশতাধিক সংগঠন তাকে গুণীজন হিসেবে সম্মননা দিয়েছেন। সম্প্রতি জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে জেলার শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি পুলিশের সদস্য হিসেবে আইজিপি পদক প্রদান করা হয়। তিনি জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
অ্যাডভোকেট এস এম ইকবাল বরিশালের এমন এক উজ্জ্বলতম নাম যিনি আইন পেশাকে পেশা হিসেবে দেখেননি কখনও। সাংবাদিক, অসহায়, গরিবদের জন্য আইনি লড়াই করতেই নিজেকে আইন পেশায় নিয়োজিত রেখেছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হলে পাশে গিয়ে পরম বন্ধুর মতো দাঁড়িয়েছেন অ্যাডভোকেট এস এম ইকবাল। নিজ খরচে তাদের মামলা লড়েছেন। বিপদে-আপদে যেমন পাশে থাকেন তেমনই সঠিক দিক নির্দেশনা দেন চলার পথের। পরোপকারী হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন এস এম ইকবাল।
সাংবাদিক এস এম ইকবালের বিষয়ে দৈনিক যুগান্তর’র বরিশাল ব্যুরো চিফ ও এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আকতার ফারুক শাহিন বলেন, আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কম-বেশি ৩৫ বছর। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে কাজ শুরু করি। তখন ছিল এস এম ইকবালের যৌবন। সাংবাদিকতায় তখন তার দুর্দান্ত দাপট। আর আপসহীনতার মনোভাব দেখেছি তার ভেতর। সত্যি কথা বলতে কি তীব্র বৈরী পরিবেশে আধুনিক প্রযুক্তিবিহীন সেই সময় যখন সাংবাদিক পেশা ছিল স্বেচ্ছা শ্রম। সেই সময়টাতে এস এম ইকবালের মতো মানুষেরা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন বলেই হয়তো এরকম কঠিন পেশায় নিজেকে টিকিয়ে রাখার উৎসাহ পেয়েছি।